সাইদ হোসেন অপু চৌধুরী : সরকারি হাসপাতালে গেলে রোগী আরও অসুস্থ হয়ে যায়, এমন ধারণা পোষণ করেন অনেকেই। আর এটিই যেন এ দেশের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার করুণ বাস্তবতা।
সরকারি হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা-আবর্জনাময় পরিবেশ, চিকিৎসক-নার্সদের অবহেলা, অপ্রতুল চিকিৎসা সরঞ্জাম, নিরাপত্তাহীনতা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ না থাকার কারণে বেসরকারিভাবে চিকিৎসাসেবা নিতে বাধ্য হচ্ছে বেশিরভাগ মানুষ।
আর সেখানে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৩০ লক্ষ মানুষের চাঁদপুর জেলার একমাত্র ভরসাস্থল ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ডা. একেএম মাহবুবুর রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পর হাসপাতালে এসেছে অনেক পরিবর্তন, বদলে গেছে সেবার চিত্র। সরকারি চিকিৎসাসেবায় আস্থা ফিরেছে মানুষের। হয়রানি আর ভোগান্তির পরিবর্তে এখন রোগীদের মুখেই শোনা যায় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রমের প্রশংসা। সেবার মানোন্নয়নের কারণে রোগী বাড়ায় এ খাত থেকে হাসপাতালের আয়ও বেড়েছে। সরকারি এ হাসপাতালে এখন অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সেবা দিচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রবেশ করলেই মনে হবে যেন কোনো প্রাইভেট হাসপাতাল। রোগী এলেই ছুটে আসছেন কর্তব্যরতরা।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর তত্বাবধায়ক হিসেবে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে যোগদান করেন ডা. মাহবুবুর রহমান। যোগদানের পরই তিনি হাসপাতালের সেবার মানোন্নয়ন, পরিচ্ছন্নতা, চিকিৎসাবান্ধব পরিবেশ ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা জোরদারের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। এর পূর্বেও তিনি ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক হিসেবে হাসপাতালের কর্মরত ছিলেন।
এর অংশ হিসেবে তিনি গেল দুই বছরে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শতভাগ বায়োমেট্রিক হাজিরা নিশ্চিত, দায়িত্বপালনকালীন সময়ে সবার নেমপ্লেট ও আইডি কার্ড নিশ্চিতকরণ, দালাল নির্মূলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, নির্দিষ্ট দিন ও সময় ব্যতিত হাসপাতালে ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের প্রবেশ নিষেধ এবং রোগীর প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলা বন্ধ, হাসপাতালের ভেতর থেকে অবৈধ দোকানপাট ও হকার উচ্ছেদ এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ জোর দেন।
তিনি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের খাবারের মানোন্নয়ন এবং চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে পরিচালক, উপ পরিচালক ও সহকারী পরিচালকদের প্রতিদিন হাসপাতালে রাউন্ড নিশ্চিত করেন। নিযুক্ত কর্মচারীরা আগে যেখানে তাদের ন্যায্য বেতন পাওয়া থেকে বঞ্চিত ছিলেন সেখানে নিজে উদ্যোগী হয়ে তাদের বেতন পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন। এতে নিযুক্ত কর্মচারীদের ন্যায্য বেতন প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। এক সময় হাসপাতালের রোগীদের মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে নানারকম হয়রানির অভিযোগ ওঠতো। মেডিকেল সার্টিফিকেট পেতে হাসপাতালে দিনের পর দিন দৌঁড়ঝাঁপ দিতে হতো।
সার্টিফিকেট পেতে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হতো সংশ্লিষ্ট রোগীকে। বর্তমান তত্বাবধায়ক মাহবুবুর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর সেই হয়রানি বন্ধ হয়েছে। এছাড়া রোগীর বিদায়কালীন ছাড়পত্র সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের নার্সিং কর্মকর্তারা বিতরণ করার নির্দেশ দেন তত্বাবধায়ক। ফলে ছাড়পত্রের জন্য রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে না। হাসপাতালের নিরাপত্তা নিয়ে রোগী, তাদের স্বজন ও চাঁদপুরের সুধীমহল থেকে আগে অনেক প্রশ্ন ওঠতো। এই অবস্থায় বর্তমান তত্বাবধায়ক দায়িত্ব নিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যাপারে বিশেষ মনযোগ দেন। তার চেষ্টায় হাসপাতালের নিরাপত্তা জোরদারে সিসি ক্যামেরার সংখ্যা বৃদ্ধি ও পুরনো অচল ক্যামেরাগুলো সচল করা হয় এবং রোগী ও তাদের স্বজনরা দালাল কর্তৃক প্রতারিত যাতে না হন সে ব্যাপারে সার্বক্ষনিক পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নেন তত্বাবধায়ক।
হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন ডা. মাহবুবুর রহমান। আগে হাসপাতালে সুযোগ না পেয়ে ও দালাল দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অনেক রোগী বাইরে থেকে পরীক্ষা করাতেন। বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন ধরণের প্যাথলজি পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ও এক্সরে বিভাগ নির্ধারিত সময়ে খোলা রাখার ব্যবস্থা করেন।
এতে একদিকে যেমনি হাসপাতালের রাজস্ব বাড়ছে, তেমনি রোগীরাও স্বল্প খরচে মানসম্পন্ন পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। হাসপাতালের সেবা সংক্রান্ত বিভিন্ন নির্দেশনামূলক পোস্টার সাঁটানোর কারণে রোগীরাও সহজে সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। প্রতারণা ঠেকাতে হাসপাতালে মানি রিসিট ছাড়া সবধরণের লেনদেন বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারগুলো সংস্কার ও মেরামত করিয়েছেন পরিচালক। হাসপাতালে সরকারি এম্বুলেন্সের সেবার মান বাড়ানো হয়েছে। ফলে সরকারি এম্বুলেন্সের প্রতি রোগীদের আগ্রহ বাড়ছে।
পাশাপাশি চাঁদপুর পৌরসভার ব্যাবস্থাপনায় নতুন আঙ্গিকে কেবিন সংস্কার এবং জরুরী বিভাগ থেকে কেবিন স্থানান্তর করে পার্শ্ববর্তী একটি জায়গায় সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি।
জানা গেছে, বছর দুয়েক আগেও হাসপাতাল চত্বরের খোলা জায়গাটি অবহেলায় পড়েছিল। ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। হাসপাতালের ভেতরটাও ছিল নোংরা। এখন চারদিক সবুজে ঘেরা। সকালে প্রধান ফটক দিয়ে হাসপাতালে ঢুকতেই সবুজে হাওয়া চত্বর চোখ জুড়িয়ে যায়। জরুরি বিভাগের সামনেই ফুলের বাগান। শোভা পাচ্ছে নানা জাতের ফুল।
হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভেতরে বাইরে ঝকঝকে পরিবেশ। ভেতরে ঢুকতেই জরুরি বিভাগ। দেওয়ালে টানানো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য তালিকা। হাসপাতালটিতে সেবা নিতে এসেও এলাকার মানুষ সন্তুষ্ট।
হাসপাতালের রোগী ও স্থানীয়রা জানান, মাস ছয়েক আগেও বেলা ২টার পর এ হাসপাতালে এলে চিকিৎসক পাওয়া যেত না। তখন জরুরি প্রয়োজনে প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। তবে এখন শুধু জরুরি বিভাগে নয়, সব বিভাগেই সার্বক্ষণিক চিকিৎসক পাওয়া যায়।
তারা জানান, আগে যেসব ওষুধ বাইরে ফার্মেসি থেকে কিনতে হতো, এখন তা বিনামূল্যে পাওয়া যায় হাসপাতালেই। রোগী নিয়ে দালালদের টানাটানি নেই। রোগ পরীক্ষার জন্যও বাইরে যেতে হচ্ছে না। এখন হাসপাতাল প্রাঙ্গণ ও আশপাশ বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। অথচ এসব এলাকা আগে আবর্জনায় ভরে থাকত।
হাসপাতালের সেবার মান সম্পর্কে মাহাবুবুর রহমান বলেন, তত্বাবধায়ক হিসেবে আমি এ হাসপাতালে যোগদানের পর অনেক অব্যবস্থাপনা আমার নজরে আসে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয়। চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিতে বায়োমেট্রিক হাজিরার ব্যবস্থা করা হয়। সে কারণে এখন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক পাওয়া যায়। বিভিন্ন রোগ নির্ণয়নের মেশিনও স্থাপন করা হয়েছে। রোগীরা এখন এসব উদ্যোগের সুফল ভোগ করছে।
তিনি বলেন, চাঁদপুর ৩ আসনের সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মণি এসব উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নে মন্ত্রী মহোদয়ের দিক নির্দেশনায় সেবার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি হাসপাতালের যোগদানের পর অনেক অচল ইউনিট সচল করেছি এবং নতুন ইউনিটও চালু করছি। ভর্তি রোগীদের খাবারের মান আগের তুলনায় এখন উন্নত।
হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। হাসপাতালের বিভিন্ন উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসক রয়েছেন ৪৯ জন, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ২২ জন এবং সেবিকা রয়েছেন ১১৮জন। এসব ডাক্তার ও নার্সরা নিয়মিত ভাবেই রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন হাসপাতালের জরুরি ও বহির্বিভাগে।
উল্লেখ্য, তিনি সদা হাস্যোজ্বল, দক্ষতাসম্পন্ন, চৌকশ একজন সরকারি কর্মকর্তা, দক্ষতা দিয়ে কর্মকাণ্ডকে যেমনি সচল রেখেছেন তেমনি আন্তরিকতা দিয়ে সহকর্মীদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধের কারণে তিনি সকলের নিকট প্রশংসিত। তার উদ্যোগে সেবার মান বৃদ্ধি পাওয়ায় একদিকে যেমন চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরছেন রোগীরা, অন্যদিকে হাসপাতালের সেবার সুনামও ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।