সাবেক এমপি ডঃ শামসুল হক ভূইয়া স্মরণে সামান্য কিছু কথা

জনাব ড. শামসুল হক ভূঁইয়া ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন সদস্য। তিনি নিজ গুণে এবং নিরলস পরিশ্রমের ফলে সমাজে প্রথম সারিতে জায়গা করে নিতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি।
আমি আমার বন্ধু সম্বন্ধ্যে দুটি কথা বলবো বলে আমি কলম ধরেছি। তিনি ছিলেন আমার বাল্য বন্ধু, গলায় গলায় মিল।
আমাদের প্রথম জীবনে লেখাপড়া আলাদা জায়গায় হলেও পরবর্তী জীবন থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত একত্রে ছিলাম।

জীবন শুরু পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। ১৯৬৩ সালে আমার এবং ১৯৬৫ সালে জনাব হকের বিমান সেনা হিসাবে বিমান বাহিনীতে চাকুরী শুরু হয়। বিমান বাহিনীর বেসিক ট্রেনিং শেষে আমরা একত্রে পোষ্টিং পাই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে করাচি শহরের মৌরিপুর বিমান ঘাঁটিতে এবং পরবর্তীতে ড্রিগ রোড বিমান ঘাঁটিতে যা ছিল পাকিস্তানের বেসামরিক বিমান ঘাঁটির কাছাকাছি।

তারপর ১৯৭১ সালের জুনের প্রথম দিকে বহু কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ের শ্রীলংকার কলম্বো বিমান ঘাঁটি হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা বিমান বন্দরে আসি এবং পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করি। আর তিনি (জব-ঢ়ধঃরৎধঃরড়হ ্ ঊী-ঢ়ধঃৎরধঃরড়হ) ক্যাম্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে আসেন এবং ঢাকায় বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। আর আমি মুক্তিবাহিনী থেকে ১৯৭২ সালের মার্চের শেষের দিকে বাংলাদেশ বিমানে যোগদান করি।

উল্লেখ্য, তৎকালীন বাংলাদেশ এবং ঢাকার সিটি আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দমনে সহায়ক ভূমিকা রাখার জন্য আমি মুক্তিবাহিনীর আলফা কোম্পানীতে কোয়ার্টার মাষ্টার হিসাবে কর্মরত ছিলাম। ১৯৭৩ সালে বিমান কর্তৃপক্ষ অপশন দিলে উক্ত চাকুরী হতে আমি ঢাকা মতিঝিলের ইপআইডিসি অফিসে সহকারী একাউনটেন্ট হিসাবে চাকুরীতে যোগদান করি।

অতঃপর সেখান থেকে বিসিএস (এডমিন) পরীক্ষা দিয়ে সরকারী চাকুরীতে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে চাকুরীতে যোগদান করি এবং সুনাম ও কৃতিত্বের সহিত দীর্ঘ ২৭ বৎসর সরকারী চাকুরী শেষে ডেপুটি সেক্রেটারী হিসাবে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বিদায় গ্রহণ করি। অতঃপর বর্তমানে দীর্ঘদিন যাবৎ অবসর জীবন কাটাচ্ছি। অন্যদিকে জনাব হক এই সময়ে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সহকারী ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে চাকুরীতে যোগদান করে চাকুরীতে বিভিন্ন ধাপ সুনাম ও কৃতিত্বের সহিত পার করে সর্বশেষ চীফ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে চাকুরী হতে বিদায় গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে কৃতিত্বের অবদান রেখে চীফ ইঞ্জিনিয়ার হন এবং সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৪ আসনে এমপি হিসাবে নির্বাচিত হন।
বিগত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে (৭ই জানুয়ারী) নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হন এবং পরবর্তীতে নানা ধরণের ‘অসুখে চলতি বছরের গত ২ ফেব্রুয়ারী পৃথিবী হইতে চির বিদায় গ্রহণ করেন। এই দীর্ঘ সময়ে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত আমরা প্রায় একত্রিতই ছিলাম।

আজ মনে পড়ে পিছনের দিনের কথা। আমি যখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অসহায় অবস্থায় সদ্য বিবাহিত স্ত্রী-কে অন্য একটি বিমান ঘাঁটির কোয়াটারে রেখে হাসপাতালের বেডে কাতরাইতে ছিলাম (সময় ছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিল-জুনের প্রথম দিক পর্যন্ত, করাচি মৌরিপুর বিমান ঘাঁটি) তখন এই শামসুল হক বন্ধুই আমাকে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করেছিলেন। এছাড়া আমার মুক্তিযুদ্ধে যোগদানেও আমার প্রতি তাহার স্মরণীয় ভূমিকা ছিল।

মানুষ মনে করতে পারে একজন ভূঁইয়া সাহেব মরলে কিছুই হয় না। কিন্তু আমি মনে করি একজন অকৃত্রিম বন্ধু চলে গেলে তার জায়গা পূরণ হবার নয়। আমি জানি আমার এই জীবন সায়াহ্নে মৃত্যুর কোন বিকল্প নেই। মৃত্যু অমোচন কালির মতো, স্বল্প সময়েই তার দাগ শুকিয়ে যায়। তবে তিনি যে কাজগুলো করেছেন তা অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে।

পিতা-মাতার প্রতি অগাধ ভালোবাসা, দান-সাদাকাত, জনহিতকর বহু কাজ করেছেন যথা-মা-বাবার নামে স্কুল কলেজ, এতিমখানা প্রতিষ্ঠা, এছাড়া অন্যান্য নানাবিধ জনহিতকর বহু কাজ করে গেছেন।
সাধারণ জনগণের অনেক উপকার করতেন। অসহায় লোকের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা পোষন করতেন। মোট কথা গরীব-দুঃখীদের জন্য তিনি ছিলেন উদার ও অত্যন্ত দানশীল ব্যক্তিত্ব। এলাকায় তাই বলে পরিচিত ছিলেন।

তার একটি বিশেষ গুণ ছিল তিনি জীবনে ব্যর্থতা মানতেন না। যে কাজ ধরতেন তা শেষ দেখে ছাড়তেন এজন্যই বিগত নির্বাচনে তিনি দুটি আসনে নির্বাচন করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।

আমার জন্য তিনি ছিলেন একজন মডেল। আমার জীবদ্দশায় ও অনুপস্থিতিতে আমার পরিবারকে তিনি সব সময় সব বিষয়ে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই চার বোন, আমরাও তাই ছিলাম। তাঁর এক ভাই মো. হাবিবউল্লাহ ভূঁইয়া আমার মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের বিষয় শুনে অনেক অনপ্রেরণা ও উৎসাহ পেয়েছিল এবং বিগত স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হয়েছেন। পরিশেষে, পরম করুণাময় আল্লাহর নিকট তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।

লেখক ঃ আলহাজ¦ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মোজাম্মেল হক, সাবেক উপ-সচিব কৃষি মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

সম্পর্কিত খবর