মতলব দক্ষিণ প্রতিনিধি : নথি জালিয়াতি করে সরকারি সম্পত্তি ব্যক্তি নামে রেকর্ড দেখিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে বহু ভুয়া খতিয়ানসহ বিভিন্ন নথি, বিনিময়ে নেওয়া হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা। বন্দোবস্ত বর্হিভূত সরকারী খাস জমি দখলে নিতে একটি প্রভাবশালী মহলের যোগসাজোসে এমন জালিয়াতি হয়েছে মতলব পৌর ভূমি অফিসে। ভুয়া খতিয়ানের জন্য মতলব দক্ষিণ উপজেলা ও মতলব পৌর ভূমি অফিসের ভলিউম বইয়ের পৃষ্ঠা পাল্টে ফেলেছে জালিয়াত চক্র। দীর্ঘ অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ সার্ভে (বিএস) জরিপ চলাকালে মতলব দক্ষিণ উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় সরকারি সম্পত্তি যেমন নদী, খাল, রাস্তা, হালট, ভিটা ইত্যাদি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক, চাঁদপুর এর নামে ১ নং খতিয়ানে রেকর্ড ভুক্ত হয়।
এরুপ সম্পত্তি ভূমি অফিসের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অর্থের বিনিময়ে ব্যক্তি মালিকানা খতিয়ানে এবং নতুন খতিয়ান সৃষ্টি করে রেকর্ড ভুক্ত করে দেয়। অনিয়মের বিষয়টি যেন পরবর্তীতে কারো চোখে ধরা না পড়ে সেই কারণেই মৌজার খতিয়ানের ভলিয়মের সূচীপত্র ও পৃষ্ঠা পরিবর্তন, রাজস্ব অফিসারের নকল সীল প্রদান এবং খতিয়ানের একাধিক পৃষ্ঠা নম্বর ছাপা দেওয়া হয়।
এভাবেই মৌজার খতিয়ান ভলিয়ম বইয়ের পৃষ্ঠা পরিবর্তন করা হয়েছে মতলব পৌর ও উপজেলা ভূমি অফিসে। তবে নথি জালিয়াতি করে সরকারি সম্পত্তি ব্যক্তির নামে করা হয়েছে মতলব পৌর ভূমি অফিসের আওতায় থাকা মৌজাগুলোতে। অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, সকল মৌজার খতিয়ান কম্পিউটারে প্রিন্টকৃত সেই মৌজায় জাতিয়ালি হয়েছে বেশি।
তথ্য সূত্রে দেখা যায়, মতলব পৌর ভূমি অফিসের আওতাধীন ১৬৬নং নিলক্ষী মৌজায় ১ থেকে ১২২ পর্যন্ত ও একটি বাট্টা খতিয়ানসহ মোট খতিয়ান রয়েছে ১২৩টি। কিন্তু মতলব পৌর ভূমি অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জালিয়াতি করে অতিরিক্ত তিনটি খতিয়ান সৃষ্টি করে এক প্রভাবশালী ও তার পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয় এক সার্ভেয়ারকে সরকারের নামে থাকা ৬ একর ৯০ শতাংশ ভূমির মালিকানা দিয়ে দেন।
সেই সাথে ১৬৯ নং দক্ষিণ উদমদী মৌজায় হাল ৭৩৩ দাগে ২৮ একর ৪০ শতাংশ নদী হিসেবে সরকারের নামে রেকর্ড ভূক্ত সম্পত্তির ৭ একর ভূমি ২৯০/১ নম্বরের নতুন একটি খতিয়ান সৃষ্টি করে ওই প্রভাবশালী পরিবারের নামে রেকর্ড ভুক্ত দেখিয়ে ভলিউমে যুক্ত করে জালিয়াতি চক্রটি। জালিয়াতি করে যাদের নামে নতুন খতিয়ান সৃষ্টি করা হয়েছিল, তাদের আস্থা অর্জনে ডিসিআর এর মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ও করেন পৌর ভূমি অফিস।
এছাড়াও, মতলব পৌরসভার ১৭২ নং বাইশপুর মৌজায় হাল ৬৩৪ দাগে খালের ৩০ শতাংশ, ৫০৩৩ দাগে খালের ১৫ শতাংশ, ৭৫৫৪ দাগে নদীর ১ একর এবং ৫৫২৫ দাগে নাল ১৮ শতাংশ সরকারি ভূমি ব্যক্তি নামে থাকা বিভিন্ন খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই সাথে নতুন করে বাইশপুর মৌজায় ৮৬১ ও ৯৯০ নং খতিয়ান সৃষ্টি করা হয়।
অপর দিকে ১৬৪ নং চর পাথালিয়া মৌজায় ৩ একর ১ শতাংশ সরকারি ভূমি অতিরিক্ত একটি খতিয়ান সৃষ্টি করে ব্যক্তি নামে রেকর্ড দেওয়া হয়েছে। ১৮১ নং দিঘলদী মৌজায় ৮৭৬৩ ও ৮৭৬৪ দাগে ৫ শতাংশ সরকারি ভূমি ২৪৯৮, ২৪৯৯, ২৫০০, ২৫০১ ও ২৫০২ নং নতুন খতিয়ান সৃষ্টি করে ব্যক্তি মালিকের নামে দেওয়া হয়েছে এবং ডিসিআর এর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায় যে, পৌর ভূমি অফিসের আওতাধীন ১৮২ নং নলুয়া মৌজায় ৩৩৭৮ দাগের ৩৪ শতাংশ, ১৮০ নং মোবারকদী মৌজার ৯৪ দাগে ১৮ শতাংশ, ১৭২ নং চরমুকুন্দি মৌজার ৩৬৮ দাগে ২৪ শতাংশ, ২৩৩ দাগে ৬৮ শতাংশ, ৯৪০ দাগে ১৬ শতাংশ এবং ৩৮৮ দাগে ১ শতাংশ সরকারি ভূমি জালিয়াতি করে জেলা প্রশাসকের কোনো আদেশ ছাড়াই ব্যক্তিগত নামে থাকা খতিয়ানে নিয়ম বর্হিভুত ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর এই সকল অন্তর্ভুক্তির জন্য খতিয়ান ভলিউমের পৃষ্ঠা পরিবর্তন করেন পৌর অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মতলব পৌরসভার নিলক্ষী, উত্তর উদ্দমদি ও দক্ষিণ উদ্দমদি মৌজায় বসবাসকারী একাধিক ব্যক্তি জানান, এই মৌজায় সরকারী অনেক খাস জমি রয়েছে। আর এই সকল ভূমি দীর্ঘ মেয়াদে লিজ পেতে তারা মতলব পৌর ভূমি অফিসের সাবেক কর্তা হাবিব উল্ল্যাহ পাটোয়ারীকে মোটা অংকের টাকা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি আজও কোনো কাগজ করে দিতে পারেননি। তবে করে দিবেন বলে আজও আশ^াস দিয়ে যাচ্ছেন হাবিব উল্ল্যাহ পাটোয়ারী।
এদিকে মতলব পৌর ভূমি অফিসের অনিয়মের বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান চলাকালে উপজেলা সহকারী কমিশনারের এক অভিযোগের প্রেক্ষিতে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রাজস্ব শাখার প্রাক্তন সিনিয়র সহকারী কমিশনার যিনি বর্তমানে নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা আক্তার ববি।
ওই তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মতলব দক্ষিণ উপজেলায় পাঁচটি তহশীল অফিস রয়েছে। যার মধ্যে মতলব পৌর ভূমি অফিসে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত যে সকল অনিয়ম হয়েছে সেই সময়ে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন হাবিব উল্লাহ পাটোয়ারী। তিনি জালিয়াতি করে ১৮ একর ৮৫ শতাংশ সরকারের নামে থাকা সম্পত্তি ব্যক্তি নামে রেকর্ড প্রদান করেছেন এবং তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।
আর এই তদন্ত প্রতিবেদনের পর অভিযুক্ত হাবিব উল্লাহ পাটোয়ারীকে (যিনি পরবর্তীতে পুনরায় ২০২৩ সালে মতলব পৌর ভূমি অফিসে যোগদান করেন) মতলব পৌর অফিস থেকে বদলি করে হাইমচর উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নের দেওয়া হয়। তদন্ত চলাকালীন সময়ে নথি জালিয়াতির বিষয়টি অভিযুক্ত হাবিব উল্ল্যাহ পাটোয়ারী কিছুই জানেন না বলে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জানালেও এর সাথে কারা জড়িত সেই বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে মত প্রকাশ করেন।
তবে নথি জালিয়াতি করে সৃষ্টি করা নতুন খতিয়ানের বিপরীতে রাজস্ব আদায়ে প্রদানকৃত ডিসিআর বইয়ে হাতে লিখার সাথে অভিযুক্ত হাবিব উল্ল্যাহ পাটোয়ারীর হাতে লিখা হুবহুব মিল পায় তদন্তকারী কর্মকর্তা। আর তদন্ত প্রতিবেদনে ভিত্তিতে মতলব পৌর ভূমি অফিসের সাবেক ইউনিয়ন সহকারী কর্মকর্তা হাবিব উল্লাহ পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা জন্য চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক গত ২২ অক্টোবর’২০২৩ সালের ১৭২১ স্বারকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর একটি পত্র প্রেরণ করেন।
এই বিষয়ে চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইমরান শাহারীয়ার বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযুক্ত হাবিব উল্ল্যাহ পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে।
অভিযুক্ত হাবিব উল্ল্যাহ পাটোয়ারী তাঁর বিরুদ্ধে চলা বিভাগীয় মামলার কথা স্বীকার করে বলেন, তিনি যড়যন্ত্রের স্বীকার, কাজ করতে গেলে অনেক সময় ভুল হয়ে যায়।