চাঁদপুরে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বরফ কল : ৩৩ টির মধ্যে এখন চলছে ২টি

এস এম রাসেল, চাঁদপুর ঃ পুঁজির অভাব,কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল এবং মাছের আমদানি কম থাকায় চাঁদপুরে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বরফ কল।

এক সময়ে এখানে চালু থাকা ৩৩ টির মধ্যে এখন চলছে মার ২টি বরফকল। পর্যাপ্ত বরফের কারনে অনেক সময় ইলিশ মাছ, জিউল মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশিয় মাছ সরবরাহে এবং সংরক্ষণে বিপাকে পড়েন এখাকার মৎস্য বাবসায়ীরা।

বর্তমানে পদ্মা-মেঘনায় মা ইলিশ ধরার নিষেধাজা ও অভয়াশ্রমের কারণে চালু থাকা কয়েকটি বরফকল বন্ধ থাকায় বড় স্টেশন মাছঘাটে বরফ সংকট দেখা দিয়েছে। দেশিয় মাছ বিক্রি করতে ব্যবসায়ীদের পড়তে হচ্ছে চরম বিপাকে। বরফ সংকটে কর্মহীন হয়ে পড়েছে বহু শ্রমিক। এ সংকট নিরসনে বর্তমানে বন্ধ থাকা কয়েকটি বরফ কল চালুর জন্য জেলা প্রশাসক বরাবরেও বরফ কল মালিক সমিতি একটি আবেদন দিয়েছেন। এতে করে ১টি বরফকল চালু থাকলেও আরেকটি বরফ কল চালু করেছে জেলা প্রশাসন। বর্তমানে বরফের ঘাটতি কিছুটা পূরণ হয়েছে বলে জানা যায়।

বর্তমানে নতুন বাজারের ইলমা শাহরিন ও পুরান বাজারের বিসমিল্লাহ নামে ২ টি বরফ কল চালু রয়েছে। বর্তমানে দেশীয় ও জিউল মাছ সংরক্ষণ এবং সরবরাহে যে পরিমাণ বরফ উৎপাদন হয় তা অপ্রতুল। মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, আরো কয়েকটি বরফকল চালু করলে বরফ সংকট থাকবে না। তবে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি পেলে নতুন বাজারের বড়স্টেশনের জলি ও রিয়াদ বরফকল, পুরান বাজারের পূবালী আইস বরফ কল ও যমুনা আইস ফ্যাক্টরি চালু করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে চালু থাকা বরফকল গুলো বন্ধ হওয়ায় এর সাথে জড়িত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিকরা দূর্বিষহ জীবন যাপন করছেন।

চাঁদপুরে উৎপাদিত বরফ জেলার ৮ উপজেলার বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হয়। ইলিশের অভিযান চলাকালীন সময়ে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের প্রত্যন্ত বাজারগুলোতে দেশিয় মাছের জন্য বরফের চাহিদা থাকে ব্যাপক। তখন ২ টি বরফ কলে উৎপাদিত বরফ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল থাকে। এ সময় পার্শ্ববর্তী জেলা থেকেও বরফ এনে ব্যবসায়ীরা মাছ সংরক্ষণ ও সরবরাহ করে থাকেন বলে জানা যায়। কিছুদিন আগেও চাঁদপুরে ৫টি বরফ কল সচল ছিল । যা থেকে সাড়ে ৩ হাজার ক্যান বরফ উৎপাদন হতো। বর্তমানে মাত্র ২টি বরফ কল বরফ উৎপাদন করছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তবে ইলিশের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে বাকি তিনটি কল চালু হবে বলে জানা যায়।

চাঁদপুর ইলিশ মাছের জন্য বিখ্যাত। ভরা মৌসুমসহ বিভিন্ন সময়ে এখানে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে। তাছাড়া উপকূল অন্চল, বরিশাল, ভোলা থেকে ইলিশ এখানে প্রচুর আমদানি হয়। এ সময় বরফের ব্যাপক চাহিদা থাকে। বিশেষ করে মার্চ ও এপ্রিল ২ মাস নিষেধাজার সময় বাদে ইলিশ সংরক্ষণ ও সরবরাহে বরফের চাহিদা প্রচুর পরিমাণে থাকে। তখন হাতে গনা কয়েকটি বরফ কল দিন-রাত উৎপাদন করেও পর্যাপ্ত বরফ সরবরাহ দিতে পারে না। বরফ সরবরাহ বেশি থাকে আগস্ট সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে।

জানা যায়, পাঁচটি বরফকল চালু থাকলে সাড়ে ৩ হাজার বরফ উৎপাদন হয়। প্রতি ক্যান বরফ পাইকারী বিক্রি করেন ১৬০ টাকা দরে। উৎপাদিত সাড়ে ৩ হাজার বরফ বিক্রি করা হয় ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু বিদ্যুৎ বিলসহ সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ এর সমপর্যায়ে চলে আসলে কিভাবে বরফ কল মালিকরা এ ব্যবসার সাথে জড়িত থাকবে এমনই প্রশ্ন করলেন বরফ ব্যবসায়ীরা।

বন্ধ থাকা বরফ কল চালু করা সম্ভব বলে বরফ ব্যবসায়ীরা জানান। তারা জানান, সরকার যদি এখাতে সুদ মুক্ত লোনের ব্যবস্হা , বিদ্যুৎ বিল হ্রাস সহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেন তাহলে পূর্বের ব্যবসায়ীরা আবার এ শিল্পে বিনিয়োগ করবে।

তবে পাইকার ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, প্রতি বছর ইলিশের ভরা মৌসুমের সময় সিন্ডিকেট করে বরফ-কল মালিকরা সংকট তৈরি করেন।

অপরদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৎস্য ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, অনেকসময় চাহিদা দেখে ১৬০ টাকা বরফ ক্যান ২০০ টাকা করে বিক্রি করছেন বরফ কলের মালিকরা। এ ছাড়াও বরফ পাতলা করায় ওজনেও কম হচ্ছে। ফলে বরফ বিক্রি করতে গিয়ে লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের।

একাধিক ব্যবসায়ী জানান, শহরের ওয়ারলেস, বিপনীবাঘ, চৌরাস্তা, ভাটিয়ালপুর বাজারসহ আরও বেশ কয়েক স্থানে গোপনে বরফ আসছে। অথচ মাছের সবচেয়ে বড় মাছঘাট বড় স্টেশনেই এখন পর্যাপ্ত বরফ নেই।

শহরের নতুনবাজারের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ইলমা শাহরিন বরফ কলের মালিক মারনুস মাহমুদ তন্ময় জানান, পদ্মা মেঘনা নদীতে প্রচুর পরিমাণে বালু উত্তোলনের কারনে মাছের ডিম বিনষ্ট হওয়ায় এবং মাছের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় আগেরমত ইলিশ,জিওল সহ দেশীয় মাছ পাওয়া যায় না। তাই ভরা মৌসুমেও মাছের সংকট দেখা দেয়। এতে করেও বরফের চাহিদা কম থাকা,বিদু্ত বিল বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বরফ কলগুলো। তবে চঁাদপুরে বরফ কল বন্ধ হলেও মালিকদের কেউ কেউ মাছের উৎপাদন সাপেক্ষে অন্য জেলায় বরফকল স্হাপন করেছেন বলে তিনি জানান।

দীর্ঘ ৩০ বছর বরফ ব্যবসার সাথে জড়িত বরফ কলের ম্যানেজার সফিকুল ইসলাম জানান, প্রচুর পরিমাণ মাছ থাকলে সমস্যা নেই। মাছ কম থাকে তখন আমাদের লোকসান গুনতে হয়। তবে শীতকালে আমরা পুরো মৌসুম লোকসান দিয়ে থাকি। তখন বরফের চাহিদা কম থাকে দীর্ঘ পাঁচ মাস পর্যন্ত। এ পাঁচ মাসের পুরোটাই লোকসানে থাকতে হয়। বরফ কলগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনে এটি একটি বড় ধরনের কারণ।

বড়স্টেশন ঘাটের শ্রমিক হোসেন বলেন, আমরা শুধু জিওল মাছ বিক্রি করছি। শরিয়তপুর থেকে আসা রুই, কাতল, মৃগেলসহ দেশি মাছগুলো এবং খুলনা থেকে আসা চিংড়ি মাছগুলো ঘাটে নিয়ে আমরা প্রতিদিন বেকায়দায় পড়ি। তাই বড়স্টেশন ঘাটে অন্তত একটি বরফ কল চালু করা প্রয়োজন।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ শবে বরাত বলেন, ইলিশ মাছ বিক্রি ও সংরক্ষণে ঘাটের কেউ যদি জড়িত থাকে কিন্তু জিওল মাছের বাজার ধরে রাখতে আরো কয়েকটি বরফ কল চালু করা প্রয়োজন। বরফ না থাকায় পাইকাররাও এখানে জিওল মাছ কিনতে আসছে না। যার কারণে এখানে বহু শ্রমিক অভাব-অনটনে অলস সময় কাটায়। তাই আরো কয়েকটি বরফ কল চালুর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক চাঁদপুর বরফকল মালিক সমিতির এক কর্মকর্তা জানান, এক সময় চাঁদপুরে জমজমাট ছিল বরফ ব্যবসা। তখন মাছের প্রচুর আমদানি হত এবং বরফের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কিন্তু একেক করে সব বন্ধ হয়ে গেছে। হাতে গনা কয়েকটি বরফ কল চালু আছে। বাকিগুলো অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল সহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে বন্ধের উপক্রম হয়ে পড়েছে। সরকার যদি এ বরফ শিল্পের প্রতি নজর দেয় বা সহযোগিতা করে তাহলে এ শিল্প আবার প্রাণ ফিরে পাবে আমি মনে করি।

উল্লখ্য,মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই দুই মাস জাটকা সুরক্ষা দেয়া গেলে ইলিশের উৎপাদন ৬ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া ২০২৩ ডালে ৪টি নদী পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়া, ধনাগোদায় শুধুমাত্র ইলিশ ৩৪০৯২মে.টন ইলিশ ও দেশীয় প্রজাতির ২৩৬৪ মে:টন মাছ উৎপাদিত হয় বলে মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়। এই বিশাল পরিমাণ মাছ সংরক্ষণ ও সরবরাহে বরফের ব্যাপক চাহিদা থাকে।

সম্পর্কিত খবর