মানুষ ক্ষণস্থায়ী জীবনের অধিকারী আল্লাহর সৃষ্টির এক শ্রেষ্ঠ জীব। জন্ম-মৃত্যুর মধ্য দিয়েই যার শুরু এবং শেষ। আমাদের চোখের সামনেই প্রতিনিয়ত এধরায় কত মানুষের আগমণ হচ্ছে আবার কতশত মানুষ সাদাকফিনে আচ্ছাদিত হয়ে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই।
এই যে আগমণ প্রস্থান, এটা আমাদের সৃষ্টিকর্তার অমোঘ এক বিধান। কিন্তু এর মাঝেও অনেকে ইতিহাসে অমর থাকেন নিজ কর্মগুণে। এসব অসাধরণ ব্যক্তিগণ তাদের জীবনকে সে ভাবেই সাজিয়ে থাকেন। তারা অনন্য,তারা অসাধারণ। তাদের তিরোধানে মানুষ কাঁদে, ভূবন কাঁদে, কাঁদে সৃষ্টিকূল।
আমার মরহুম পিতা পীরে কামেল আল্লামা আরিফ উল্যাহ খান (রহঃ) এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর বর্ণীল কর্মময় জীবনে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন এমন সব দৃষ্টান্ত, যা একজন মানুষের পরিচালনার জন্য যথেষ্ট উপাদান হিসাবে কাজ করতে পারে। যাঁর কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি অনন্ত কাল।
নিজের মরহুম দাদা হুজুর কেবলা, ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দেদে জামান আবুবকর সিদ্দিকী আলকুরাইশী ফুরফুরাভী রহঃ এর খলিফা, ঐতিহ্যবাহী বাগাদী দরবার শরীফের আ’লা হযরত পীরে কামেল আলহাজ্ব হযরত মাওলানা সালামত উল্যাহ খান ফুরফুরাভী রহঃ এর স্নেহ-আদর- ভালোবাসা আর আদর্শ বুকে ধারণ করে, নিজ পিতা পীরে কামেল আল্লামা ছায়াদ উল্যাহ খান (রহঃ) এর গভীর সান্যিদ্ধে থেকে দোয়া ও ইজাজত প্রাপ্ত হয়ে ফুরফুরার ‘হুজুর কেবলা অসিয়ত ও নিজ ভগ্নিপতি যাত্রাবাড়ীর / নানুপুরের পীর সাহেব এর খেলাফত প্রাপ্ত হয়ে ধীরে ধীরে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধি লাভকরে মানুষকে আধ্যাত্মিক দীক্ষা ও আমজনতাকে হেদায়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বিভিন্ন এলাকায় ওয়াজ-নসিহত, মানুষের প্রাত্যহিক সমস্যার শরয়ী ব্যাখ্যা প্রদান ও মানুষকে হেদায়াতের পথে আহবান জানানোর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর গোটা জীবন অতিবাহিত করেন।
সুদুর শরীয়তপুরে দাদার ও বাবার আবাদকরা স্থানে খানকাহ প্রতিষ্ঠা, উম্মতের হেদায়াত, মুরিদানের আত্মিক প্রশিক্ষণ ও দিক নির্দেশনার জন্য সু-দীর্ঘ্য সময় খানকাহ পরিচালনা করেন, নিজ খানকায় মাসিক তালিমী জলসা ও হালকায়ে জিকিরের মজলিশ চালুকরেন।
দীর্ঘ অনেক বছর বাগাদী দরবার শরীফের নিজ মসজিদে রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করতেন। হযরতের মৃত্যুপরও তাঁর রেখে যাওয়া কার্যক্রম ধারাবাহিক ভাবে চলে আসছে।
বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসাপৃষ্টপোষকতাওপরিচালনাও উন্নয়নে জীবনের কর্ম-পরিধি সংকোচন করেননি, তিনি দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে বহু মসজিদ মক্তব, স্কুল, মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত ছিলেন। সমাজসেবায় হযরতের সাধনা একজন দরদী সমাজসেবক ছিলেন। এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁর প্রচেষ্টা ছিলো উল্লেখ করার মত। তারই ন্তেকালের পর ২০১৬ সালে তাঁর নামে পীরে কামেল আলহাজ ¡মাও: আরিফ উল্লাহ খান রহ : ফাউন্ডেশন ও লিল্লাহ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়।
হযরত আমাদের মধ্য থেকে চলে গেছেন, কিন্তু এমন সব ঘটনা পুঞ্জি তিনি রেখে গেছেন, যা দেশ বাসীর মনে যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
২০১৫ সালের ২৮ ইজুলাই, ৮ রমজান শুক্রবার তিনি ঠোঁটের কোনে নূরানী হাসির উজ্জল জ্যোতি ছড়িয়ে, উপরেরদিকে তাকিয়ে চিরদিনের জন্য বেলা ৯টার সময় একীর্তিমান মনীষী সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে তার পরম প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন)।তার প্রিয় কর্মস্থল বাগাদী আহমদিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার মাঠে জানাজার নামাজ আদায় করেন। জানাজায় ইমামতি করেন মরহুমের বড় ভাই পীরসাহেব আলহাজ্ব মাওঃ এ কে এম নেয়ামত উল্যাহ খান।
পরিবারের পক্ষ থেকে সকলের কাছে দোয়া কামনা করেন মরহুমের বড় সাহেবজাদা পীরজাদা আল্লামা আশেকুল আরেফীন সিদ্দীকী।
জানাজা পূর্বে মুসল্লিদের সমাবেশে মরহুমের কর্মময় জীবনের উপর স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য রাখেন ইসলামপুর গাছতলা দরবার শরীফের পীর আল্লামা মাওঃ খাজা ওয়ালী উল্যাহ, নানুপুর পীর সাহেবের জামাতা মুহাদ্দিস মাওঃ মেহেদী হাসান, বাগাদী আহমদিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওঃ আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ খান, উপাধ্যক্ষ মাওঃ আহসান উল্যাহ, চাঁদপুর আহমদিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওঃ মুস্তাফিজুর রহমান, বালিথুবা দরবার শরীফের পীর মাওঃ মমিনুল হক,বাগাদী ইউনিয়ন এর চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন গাজী বিল্লাল, রোটারিয়ান মোঃ মিজানুর রহমান খান, মরহুমের চাচাতো ভাই মোঃ সাইফুল্লাহ খান নোমানী, নিকটাত্মীয় কবির আহমদও সমানী, মাওঃ আবুজাফর মোঃ সালেহ, বাগাদী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী পাঠান, ভাতিজা বরকত উল্যাহ খান, জেলা কাজী সমিতির সভাপতি মাওঃ ফজলুল কবির, মরহুমের মেজ সাহেবজাদা পীরজাদা মেহেদী হাসা নখান ও হুজুরের বহুল জনপ্রিয় একটি মোনাজাত পড়ে শুনানা হুজুরের ছোট সাহেবজাদা পীরজাদা জুনায়েদ উল্যাহখান , পরিচালনা করেন পীরজাদা মাওলানা মাহফুজ উল্যাহ খান।
ঐতিহাসিক জানাযাও চতুর্দিকে শোকের গুঞ্জরণ হযরতের ইন্তেকালের সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে আপামর জনসাধারনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
গ্রাম-গঞ্জ, হাট-বাজার, শহর-নগর সবজায়গায় চলে একই আলোচনা, মসজিদ মাদ্রাসা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করে অনেক খতমে কুররান ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। হযরতের চেহারা একবার দেখার জন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানুষের সে কী ভীড়। হাসপাতাল থেকে তার লাশ বেরকরার সময়ক র্তব্যরত ডাক্তার, নার্স উপস্থিত সকলেই মানুষের উপস্থিতি দেখে হতবাক হয়ে পড়েন। পরে তার মরদেহ বাগাদী দরবার শরীফে নিয়ে আসা হয়। তাঁর ইন্তেকালে এলাকার মানুষ শোকাতুর হয়ে পড়ে।
হযরতের লাশ বাড়িতে আসার সাথে সাথে এক করুণ হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণাহয়। সকলের মুখে শোকের চিহ্ন। চেহারায় বিষন্নতার চাপ। চোখে অশ্রুর বন্যা। পীরে কামেল আলহাজ্ব হযরত মাওলানা আরিফ উল্যাহ খান রহ.ছিলেন ঈমান -ইলমে- আমলে- আখলাকে উদারতা ও মহতএকজন ইনসানে কামেল- একথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলাযায়। প্রতি-পালকের নূরে-রহমতে যিনি ছিলেন সদা উদ্ভাসিত, সেই মুকুটহীন সম্রাট আজ তার দাদা হুজুর কেবলা বাবা হুজুর কেবলাও নিজের স্বহস্তে গড়া ফুলবাগান প্রাঙ্গনে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে। হেরাহবার! আপনার বারযখের নিবাসহোক রহমতের। আপনার কবর হোক আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতে ভরপুর শান্তির গুলবাগে। হে মহান আল্লাহ! আমাদের সবাইকে হুজুরের পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফিক দিন। আমীন।
লেখক পরিচিতি : পীরজাদা মাওলানা আশেকুল আরেফিন সিদ্দীকি : এমফিল : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কামিল (হাদিস), বিএ অনার্স (ইসলামিক স্টাডিজ) . এমএ মাস্টার্স (অল ফার্স্ট ক্লাস), পীর-সাহেবজাদা, বাগাদী দরবার শরীফ. চাঁদপুর সদর।