শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চালাচ্ছে প্রাইভেট বাণিজ্য!

স্টাফ রিপোর্টার : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চালু রয়েছে চাঁদপুরের কয়েকটি কোচিং সেন্টার। কোচিং বাণিজ্য এবার নাম বদলে চলছে প্রাইভেট। পরীক্ষার সময় স্কুল শিক্ষকদের কোচিংয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ব্যাচ পড়ানোর আদলে বছরের পর বছর দেদারসে চলছে প্রাইভেট বাণিজ্য।

ব্যাচ বা প্রাইভেট যে নামেই বলা হোক না কেন, আসলে তা মোড়ক পাল্টে পুরানো কোচিং চলছে জমজমাট।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চাঁদপুর সদর উপজেলার ৫নং রামপুর ইউনিয়নের ছোট সুন্দর আমজাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের গনিত বিষয়ের শিক্ষক মোঃ তাজউদ্দীন আহমেদ ছোট সুন্দর পূর্ব বাজার সংলগ্ন তালুকদার বাড়িতে খুলে বসেছে এক মিনি স্কুল। প্রাইভেটের নামে এই মিনি স্কুলে সকাল ৯টায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী ভিতর ও বাহিরে অবস্থান করছে। তাও সবগুলো শিক্ষার্থী ঐ শিক্ষকের নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।

এদিকে ছোট্ট রুমে ১ ঘণ্টার কোচিংয়ে ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থীকে একত্রে পড়ানো হচ্ছে। এতে দায়সারা পাঠদান হলেও মূলত শিক্ষার পরিবেশ নেই। এছাড়াও অভিযোগের ভিত্তিতে একই বিদ্যালয়ের আরো কয়েকজন শিক্ষকের নামও উঠে এসেছে এ প্রাইভেট বাণিজ্যে।

স্থানীয় কয়েকজন বলেন, এক সময় শিক্ষার্থীরা এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাশ করার পর আশপাশের ২-৪ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে নিজের পকেট খরচ চালাতো। অথচ এই প্রাইভেট বাণিজ্যের কারনে আজ তারা বঞ্চিত। কারন স্কুলের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে ঐসব শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল করার সম্ভাবনা কম থাকে। এজন্য বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছেই পড়াতে বাধ্য হন।

প্রাইভেট পড়তে আসা কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, আমরা অনেকদিন যাবত এই শিক্ষকের কাছেই প্রাইভেট পড়ি। এখানে কয়েকটি ব্যাচ এ ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাইভেট পড়তে আসে। আমরা স্যারকে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা করে দেই। আবার অনেকে বলেন, আমাদের অভিভাবকরাই স্যারের কাছে প্রাইভেটের বেতন পৌঁছে দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অভিভাবক বলেন, ক্লাসে তো আর সব পড়ানো হয় না। বাধ্য হয়ে ছেলে-মেয়েদের কোচিংয়ে পড়তে দিতে হচ্ছে। এমনও শিক্ষক রয়েছেন, তার কাছে প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যায় না।

এদিকে সরকারের নির্দেশ অমান্য করে প্রাইভেট পরিচালনার বিষয়ে ছোট সুন্দর এ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ তাজউদ্দীন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তবে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য তিনি অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, আমি একা তো শুধুমাত্র পড়াইনি। দেশের সকল বিদ্যালয়ের শিক্ষরাই তো কম বেশি পড়ান। উক্ত বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির এক সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, ঐ শিক্ষক যেটা করেছে আসলে সেটা সম্পূর্ণ অন্যায়। এটা মোটেও ঠিক হয়নি।

এ বিষয়ে ছোট সুন্দর এ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কারো প্রাইভেট পাঠদানের অনুমতি নেয়। কেউ যদি সরকারি নীতিমালা অমান্য করে প্রাইভেট বা কোচিং চালান, তাহলে এর দায় তার নিজের। তবে বর্তমানে অহরহ শিক্ষকরাই প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। চাঁদপুর সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ কামাল হোসেন বলেন, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে।

সেই নীতিমালা অমান্য করলে উপজেলা কিংবা জেলা প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিবেন। জেলা শিক্ষা অফিসার প্রাণ কৃষ্ণ দেবনাথ রবিবার (১১ জুন) এ প্রতিবেদককে বলেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কথা চিন্তা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১২ সালে একটা সঠিক নীতিমালা জারি করেছে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষকরা তা মানছে না।

তবে অভিভাবক কিংবা সচেতন মহলের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত স্বাপেক্ষ প্রশাসন তা বাস্তবায়ন করবে। তারপরও আমি ছোট সুন্দর আমজাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে বিষয়টি জেনে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা শাহনাজ বলেন, আমি উক্ত অভিযোগের বিষয়টি জেনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যা তাদের পরিবারের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে। অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনোযোগী না হয়ে প্রাইভেটে বেশি সময় ব্যয় করছে। তাতে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত হাইকোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত রিট পিটিশনের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর কোচিং বাণিজ্য বন্ধে একটি গেজেট নোটিফিকেশন বা অন্য কোনোরূপ আদেশ প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি ও হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকার কর্তৃক কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

আর ওই নীতিমালা অনুযায়ী কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ছাত্রছাত্রীর তালিকা, রোল, নাম ও শ্রেণি উল্লেখ করে জানাতে হবে।

উল্লেখ্য, ছোট সুন্দর আমজাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ তাজউদ্দীন আহমেদকে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র সদর উপজেলার এম এম নুরুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ে দায়িত্ব অবহেলার কারনে বহিষ্কার করেন প্রশাসন।

 

সম্পর্কিত খবর