চাঁদপুর ও হাইমচরে অবাধে চিংড়ি রেণু আহরণে ধ্বংস হচ্ছে জলজ প্রাণী

মোঃ হোসেন গাজী : চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় অবাধে চলছে গলদা চিংড়ি’র রেণু বাণিজ্য। জোয়ার-ভাটার সময় বুঝে শেষ বিকেল থেকে শুরু করে রেণু নিধন চলতে থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। বাড়তি লাভের আশায় এক শ্রেণির অসাধু ও মৌসুমী জেলে এই কাজে যুক্ত হচ্ছেন।

মৎস্য গবেষকরা বলছেন, নদী থেকে একটি চিংড়ি রেণু আহরণের সময় মাছ, জুপ্লাংকটনসহ বিভিন্ন জলজ প্রজাতির সাড়ে ৭৭৮টি রেণু ও লার্ভি নষ্ট করা হচ্ছে। মাছের রেণু রক্ষা করা না গেলে জীববৈচিত্র নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে দেশীয় প্রজাতির অনেক মাছ বিলুপ্তির শঙ্কা রয়েছে।

প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২০০২ সালে গলদা চিংড়িসহ সব ধরনের মাছের রেণু পোনা আহরণ নিষিদ্ধ করে সরকার।

সম্প্রতি হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী ও চাঁদপুর সদর উপজেলা, লক্ষীপুর মডেল ইউনিয়ন, হানারচর, চান্দ্রা, রাজরাজেশ্বর, ইব্রাহিমপুর  এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মেঘনা নদীর তীরে দলবেঁধে চিংড়ি রেণু আহরণ করছে জেলেরা। শহরের পুরানবাজার এলাকা থেকে শুরু করে চরভৈবরীসহ চরাঞ্চরের বিভিন্ন স্থানেও নিয়মিত চোখে পড়ে এমন দৃশ্য। গোধূলী লগ্ন থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এই নিষিদ্ধ কার্যক্রম।

মূলত মশারি জাল দিয়ে তৈরিকৃত এক ধরনের বিশেষ জাল (ঠেলা জাল) দিয়ে নদী থেকে চিংড়ির রেণু আহরণ করে থাকে জেলেরা। এসময় চিংড়ির পাশাপাশি নদীতে থাকা সকল ধরনের মাঝের পোনা ও লার্ভি উঠে আসে জালে। পরে সেগুলো থেকে বাছাই করে গলদা চিংড়ির রেণুগুলো সংরক্ষণ করলেও নির্বিচারে নষ্ট হচ্ছে অন্যান্য মাছের পোনা।

হাইমচর উপজেলার কাটাখালী এলাকার জেলে তাজুল ইসলাম বলেন, চিংড়ির রেণু ধরে প্রতিদিন পাঁচশ থেকে ১২শ’ টাকা আয় হচ্ছে আমাদের। যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর মাছের ঘেরে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে গলদা চিংড়ির রেণুর। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে পঞ্চাশ পয়সা থেকে ২ টাকা পর্যন্ত প্রতি পিস রেণু বিক্রি করা হয়ে থাকে। চরভৈরবী এলাকার জেলে রূপম ইসলাম বলেন, চিংড়ি’র রেণু ধরা যে অবৈধ তা আমরা জানিনা। সংসার চালাতে পেটের দায়ে রেণু আহরণ করি আমরা। রেণু ধরতে গিয়ে হয়তো কিছু পোনা মারা যায়। তবে গলদা চিংড়ির রেণু বেছে বাকি মাছের রেণু আমরা নদীতে ফেলে দেই।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার বলেন, প্রতিনিয়ত মাছের রেণু নিধণের ফলে নদীতে সংকট দেখা দিয়েছে মাছ উৎপাদনে। এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। আগে নদীতে বড় সাইজের চিংড়ি মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আর তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। চিংড়ির দামও অনেক বেশি। নদীতে মাছের রেণু সংরক্ষণ করা না গেলে আগামীতে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তি হয়ে যাবে। চাঁদপুর কোস্ট গার্ডের স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মাশহাদ উদ্দিন নাহিয়ান বলেন, চাঁদপুর ও এর আশপাশের জেলা থেকে আহরণ করা গলদা চিংড়ির রেণু পরিবহনের মাধ্যমে পাচার করা হয় দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে। যা বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তা জব্দ করে নদীতে অবমুক্ত করা হয়।

তিনি জানান, ২০২২ সালে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ২৩ লাখ পিস চিংড়ির রেণু জব্দ করে কোস্ট গার্ড। যার আনুমানিক মূল্য ৯২ লাখ টাকা। এবং ২০২৩ সালের মে পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে জব্দ করে ৪৩ লাখ পিস রেণু। যার মূল্য প্রায় ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। কোনো অবস্থায় যেন জেলেরা নদীতে চিংড়ির রেণু আহরণ করতে না পারে সে ব্যাপারে তৎপরতার পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও চিংড়ি গবেষক ড. মো. হারুনর রশিদ বলেন, কোনো অবস্থাতেই মাছের রেণু আহরণ করা ঠিক নয়। এতে করে পরিবেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

তিনি জানান, চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, নদী থেকে একটি চিংড়ির রেণু ধরার জন্য মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রজাতির প্রায় ৭৭৮টি পোনা ও লার্ভি নষ্ট করা হয়। প্রতি বছর প্রাকৃতিক উৎস হতে রেণু আহরণের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে জলাশয়ের জীববৈচিত্র বিনষ্ট হওয়াসহ অনেক মাছ বিলুপ্তি আশঙ্কা রয়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণে কৃত্রিমভাবে গলদা চিংড়ির রেণু উৎপাদন করার পাশাপাশি জেলেদের সচেতন করা প্রয়োজন ।

সম্পর্কিত খবর