মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনায় দুই শিক্ষককে বরখাস্ত

মাসুদ হোসেন : চাঁদপুর সদর উপজেলার ৪নং শাহমাহমুদপুর ইউনিয়নের ঘোষেরহাট এলাকায় আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুস সালাম মাদ্রাসায় শিশু শিক্ষার্থীকে কয়েকদফায় পিটানোর ঘটনায় অভিযুক্ত দুই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।

সোমবার (২৭ মার্চ) সকালে আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুস সালাম মাদ্রাসায় গিয়ে জানা যায়, গত শুক্রবার মাদ্রাসার কিতাব বিভাগের ছাত্র আব্দুল আহাদ (১৫) কে মোবাইল চুরির অপরাধে বেদম নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক হাফেজ জাকারিয়া ও ইমরানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।

উক্ত ঘটনাটি গত ২৬ মার্চ রবিবার দৈনিক চাঁদপুর খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ঐদিনই তাদেরকে বরখাস্ত করেন এবং বরখাস্তের বিষয়টি দৈনিক চাঁদপুর খবরকে নিশ্চিত করেছেন মাদ্রাসার মোহতামিম আসাদউল্যাহ ও পরিচালনা কমিটির সদস্য মোঃ জামাল গাজী এবং শাহজালাল দেওয়ান।

এবং সোমবার সকালে চাঁদপুর সদর মডেল থানার এসআই মেহেরাজসহ পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে এর সত্যতা পেয়েছে। তবে নির্যাতিত ঐ ছাত্রের পরিবারের সাথে সমঝোতায় যাবে বলে জানিয়েছেন মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদ। এদিকে চাঁদপুর জেলা পুলিশ সুপার মোঃ মিলন মাহমুদ বিপিএম (বার) উক্ত ঘটনার বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, চাঁদপুর সদর উপজেলার ২নং আশিকাটি ইউনিয়নের সেনগাঁও গ্রামের মোঃ জহির পাটওয়ারীর ছেলে আব্দুল আহাদ (১৫) কে শাহমাহমুদপুর ইউনিয়নের আলুমুড়া ঘোষেরহাট এলাকায় অবস্থিত আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুস সালাম মাদ্রাসায় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে আসছে।

গত মঙ্গলবার ঐ ছাত্র তার কিতাব বিভাগের এক শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে কক্ষে গিয়ে দুষ্টমির ছলে হিফজ বিভাগের অন্য এক ছাত্র নূরে আলমসহ শিক্ষকের অকেজো একটি মোবাইলসহ অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে চলে গেলে পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হলে শুক্রবার তাকে ডেকে নিয়ে পরিবার কিংবা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে অবগত না করে মাদ্রাসার একটি কক্ষে কিছু বেত্রাঘাত করে স্বীকারোক্তি নেয় অভিযুক্ত শিক্ষক হাফেজ জাকারিয়া ও ইমরান হোসেন।

স্বীকারোক্তি নেয়ার পরও ঐ ছাত্রের উপর আরো বেদম আঘাত করে কক্ষের মধ্যে আটকে রেখে চলে যায় জুমার নামাজ আদায় করতে। জুমার নামাজ শেষে কিছুক্ষণ পর আবারো শুরু হয় পাশবিক নির্যাতন। মারধরের পর ছাত্র আহাদকে আবারো কক্ষে আটকে রেখে মসজিদে চলে যায় আসরের নামাজ পড়তে।
এদিন রাতেই আব্দুল আহাদের বাবা জহির পাটওয়ারীকে খবর দিয়ে চুরির অপরাধের কথা বলে তার বেডিং সহ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন শিক্ষকরা।

পরিবারের কাছে ভয়ে প্রথমে শারীরিক নির্যাতনের কথা স্বীকার না করলেও পরবর্তীতে সকল ঘটনা খুলে বলেন ছাত্র আব্দুল আহাদ। তার বাবা জহির পাটওয়ারী ঐদিন রাত ও পরদিন সকালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি অবগত করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে আরো জানা যায়, এই শিক্ষার্থী ঘটনার দিন প্রথম রোজা থাকা অবস্থায় তাকে মারধর করে তার শিক্ষকরা।

আব্দুল আহাদ এর পিতা মোঃ জহির পাটওয়ারী বলেন, আমার ছেলেকে এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে আসছি। সে যদি বড় ধরনের কোন অন্যায় করে থাকে, তাহলে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আমাকে জানাতে পারতো। কিন্তু তারা সেটা না করে আমার ছেলের উপর অমানবিক বেত্রাঘাত করায় পুরো শরীরে এখন আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শনিবার দুপুরে তাকে ২৫০ শয্যা চাঁদপুর সদর হাসপাতালের নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আসি। তার নানা বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক গাজী জানান, এর আগেও গত ৮ মাস পূর্বে আমার ছোট নাতি সিফাত (১০) কে এ মাদ্রাসার শিক্ষক আমিনুল ইসলাম তার ইচ্ছে মত শারীরিক নির্যাতন করেছে। ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবী করছি।

এদিকে শনিবার (২৫ মার্চ) সকালে সরেজমিনে আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুস সালাম মাদ্রাসায় গিয়ে অভিযুক্ত দুই শিক্ষক, মোহতামিম ও মোতোয়ালি আতাউর রহমান মুন্সি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, উক্ত ঘটনাটি আসলেই দুঃখজনক। শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের শাসন করতে পারেন কিন্তু এই ছাত্রকে মাত্রাতিরিক্ত আঘাত করা মোটেও ঠিক হয়নি। আমরা মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদ সহ শনিবার বাদ মাগরিব বসে বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করবো।

জনমনে প্রশ্ন, ছাত্র আহাদের চুরির বিষয়টি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কিংবা তার পরিবারের কাউকে না জানিয়ে এভাবে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে কেন? সেই সাথে সহযোগী নূরে আলমও এ ঘটনার একজন অপরাধী। তাকে তার বিভাগের শিক্ষক বিষয়টি মানবিকভাবে নিতে পারলে আহাদের বেলায় এমন হলো কেন? একজন ছাত্র রোজা থাকা অবস্থায় তাকে কয়েকধাপে শারীরিক নির্যাতন করে তালাবদ্ধ অবস্থায় কক্ষে রেখে জুমার নামাজ ও আসরের নামাজ পড়তে না দিয়ে চলে যাওয়া কতটুকু যৌক্তিক এখন শুধু ভাবনার বিষয়।

এছাড়াও একই এলাকার সুমন গাজীর ছেলেকেও গত প্রায় দুই মাস আগে এই মাদ্রাসার শিক্ষক আমিনুল ইসলামের সাথে পড়াশোনা নিয়ে মনমালিন্য হয়ে নিয়ে যান অন্য মাদ্রাসায়। আর এরকম যদি হয় মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা তাহলে ভেঙ্গে পড়বে স্বনামধন্য এ প্রতিষ্ঠানটির গুণগতমান।

এমনিতেই দেশে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিশু শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনা নতুন নয়। প্রায়শ মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তুচ্ছ কারণে শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ ওঠে। শিশু শিক্ষার্থীদের উপর মাদ্রাসা শিক্ষকদের চালানো নির্মম নির্যাতনের একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরালও হয়েছে। একাধিক শিক্ষককে কারাগারেও পাঠিয়েছে আদালত।

সম্পর্কিত খবর