চাঁদপুরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে ১ বছর ১৪ শ ৮৩ অভিযান

সাইদ হোসেন অপু চৌধুরী : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাজ হলো দেশকে মাদকমুক্ত করা। মাদক হলো এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা পরিবর্তন করে, নেশা, আসক্তি এবং বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে।

আইনিভাবে নিয়ন্ত্রিত ওষুধ ছাড়াও, গাঁজা, হেরোইন, অ্যাম্ফেটামিন, কোকেন, তামাক, অ্যালকোহল ইত্যাদিও মাদকের অন্তর্ভুক্ত। মাদকাসক্তি এক ভয়াবহ মরণব্যাধি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যে সকল সমস্যা বিদ্যমান তার একটি অন্যতম সমস্যা হচ্ছে মাদকের ভয়াল থাবা। দিন দিন মাদকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। প্রবাদে আছে চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। বর্তমানে দেশের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মাদকের কেনাবেচা হয় না। শহর থেকে শুরু করে গ্রামেও এটি সহজলভ্য।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলায় সহকারী পরিচালক হিসেবে মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান যোগদান করেন। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তাকে একই কর্মস্থলে উপ-পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। যোগদানের পর থেকে আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে থাকে চাঁদপুরের পুরনো সব দৃশ্যপট। চাঁদপুরের ৮ উপজেলায় এখন শুধু মাদক নির্মূলের পথেই নয়। বরং মাদক প্রবণতার অপরাধ শূন্যের কোটায় নেমে এসে আইন শৃঙ্খলারও অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়ে সর্বত্র যেন শান্তির সুবাতাস বইছে।

এরই ধারাবাহিকতায় গেল ১৩ মাস ধরে বিরামহীনভাবে চাঁদপুরের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান জেলার বিভিন্ন স্কুলে ক্যাম্পিং, কারাবন্দীদের সংশোধনের লক্ষ্যে একাধিক সতচেতনতা সভা, মাদ্রাসা, মসজিদ, পাড়া-মহল্লা, ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে ও হাট-বাজারে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ইভটিজিং, বাল্য বিবাহ ও মাদক বিরোধী সচেতনতামূলক মতবিনিময় সভা, মাদক নির্মূলে লিফলেট, জ্যামিতি বক্স ও কলম বিতরন করে জেলা জুড়ে ব্যাপক গণসচেতনা সৃষ্টি করেছেন। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদকের কুফল তুলে ধরে মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করতে উৎসাহিত করেছেন।

মুস্তাফিজুর রহমানের এমন জনকল্যাণকর সচেতনতামূলক এসব সভায় জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের লোকজন অংশ নেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, মুস্তাফিজুর রহমান যোগদানের পর এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪৮৩টি অভিযানে’ ২২৪০ পিছ ইয়াবা, ১৩৪ কেজি ১০০ গ্রাম গাঁজা, ১৭ বোতল বিদেশী মদ, ৫ হাজার ১৭০ টাকা, ১২২ জন মাদক কারবারীকে গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে ১১৪টি মামলা দায়ের করতে সক্ষম হয়েছেন। এর সাথে মাদক পরিবহনের দায়ে ১টি প্রাইভেট কার, ১টি পিকআপ, ১টি মোটর সাইকেল এবং ১০ টি মোবাইল সেট জব্দ করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) এক সাক্ষাৎকারে মাদক নির্মূলের সাফল্য প্রসঙ্গে চাঁদপুরের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তরিকভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছি বলেই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে। ‘কেউ অপরাধ করলে ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। মাদক সমস্য শুধু বাংলাদেশের নয়। সারা পৃথবীতে এখন মাদক একটি বড় সমস্যা।

তিনি বলেন, মাদক সেবনে মানুষের শারীরিক ও মানসিক উভয়প্রকার ক্ষতিসাধন হয়। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক ও শ্বাসযন্ত্রের কার্যক্ষমতা দিন দিন কমতে থাকে। এসব জীবন বিধ্বংসী ক্ষতিকারক দ্রব্য সেবনের ফলে যুবসমাজের সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। এরই পরিণাম স্বরূপ ছেলেমেয়ের হাতে মা-বাবা খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাহাজানি এখনকার নৈমিত্তিক ঘটনা। একজন বাবা, একজন মা এবং তার পরিবারের সদস্যরা, তাদের পরিবার নিয়ে স্বপ্ন থাকে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা থাকে। সেখানে যদি দেখা যায় যে এরকম পরিস্থিতি, তখন স্বাভাবিকভাবেই তখন স্বপ্নভঙ্গের সম্ভাবনা থাকে। মাদকদ্রব্য সেবনে এই প্রতিটি ব্যক্তি নিজেরা যেমন ধ্বংস হচ্ছেন, একই সাথে তারা বিপর্যস্ত করে তুলছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবন।

উপ পরিচালক বলেন, আজকে যারা স্কুল বা কলেজে পড়ছে, তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তাদের নিয়ে পরিবার, স্বজন, প্রতিবেশীসহ সবাই স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কোনো কারণে কেউ যদি মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তাকে নিয়ে আর কেউ স্বপ্ন দেখে না। মাদকাসক্তির কারণে পরিবার, প্রতিবেশী বা সমাজ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। মাদকাসক্তি সবকিছুকেই ধ্বংস করে দেয়।

মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাদক সেবনের কারণে লিভারের সমস্যা, হেপাটাইটিস, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জটিল রোগসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে যায়। যারা গ্রুপে মাদক গ্রহণ করেন তাদের সংক্রমণের হার বেড়ে যায়। সমাজের মানুষকে সচেতন হতে হবে, যারা মাদকের সাথে জড়িত তাদেরকে সমাজ থেকে প্রতিহত করতে হবে, মাদক মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে।

মাদক প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন এনজিও, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম বা অন্যান্য ধর্মের বিশিষ্টজন, পিতামাতা, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে থেকে তাঁরা তাঁদের বক্তব্য ও কর্মের মাধ্যমে জনগণকে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলবেন এটা আমাদের প্রত্যাশা। স্কুল- কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদকের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে শিক্ষাদান ও বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।

মাদকের এই নীল দংশন থেকে যুব সমাজকে বাঁচাতে হলে গড়ে তুলতে হবে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা।

সম্পর্কিত খবর