মাসুদ হোসেন : হাজীগঞ্জ উপজেলা, চাঁদপুরের একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক খুনের ঘটনায় রক্তাক্ত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। গত ১৯ মাসে উপজেলাটিতে ঘটেছে ১৪টি খুনের ঘটনা, যা পুরো উপজেলাজুড়ে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমন নির্মম মৃত্যুর সংখ্যা শুধু শহরবাসীকেই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও চরম চাপে ফেলেছে। শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার এক ভয়াবহ অনুভূতি।
জানা যায়, গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মাত্র ১৯ মাসে হাজীগঞ্জে অন্তত ১৪ জন মানুষ খুনের শিকার হয়েছে। অল্প কয়েক মাসের ব্যবধানে ঘটেছে দুটি চাঞ্চল্যকর ডাবল মার্ডারের ঘটনা। গত কয়েক মাসেও একটি ডাবল মার্ডারের ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি পুলিশ। আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবে মৃত্যু, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুসহ নানা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় হাজীগঞ্জে লাশের মিছিল বাড়ছে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এক ধরনের আতঙ্ক এবং উৎকণ্ঠা।
গত ২০ ও ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হাজীগঞ্জ বাজার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে সাইমন (১৬) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। পরে ঢাকর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় তার মামা সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে হাজীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ১ জনকে আটক করা হয়েছে।
এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর হাজীগঞ্জ পৌরসভাধীন টোরাগড় সরকার বাড়ির আক্তার হোসেন (৫৮) কে তার ছেলে সাকিব হোসেন (২৫) কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
মামলা হলেও এখনও ছেলে আটক হয়নি। গত ৪ আগস্ট পৌরসভার টোরাগড় গ্রামের আজাদ সরকারকে (৬৫) প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এই ঘটনায় তার ছেলে আহমেদ কবির হিমেল বাদী হয়ে হাজীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ২ জনকে আটক করা হলেও প্রধান আসামিরা পলাতক রয়েছে।
গত ১৮ আগস্ট রাতে পৌরসভার কাজিরগাঁও রেলক্রসিংয়ে চলন্ত কাভার্ড ভ্যানে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে গাড়ির হেলপার আব্দুল মজিদ (২০) এর ৭০ শতাংশ শরীর পুড়ে যায়। চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মামলা হলেও এখনও পর্যন্ত কাউকে আটক করা হয়নি।
গত ২৭ মে রাতে উপজেলার রাধাসার গ্রামের বকাউল বাড়ি আরাফাত (১২) ও তার দাদি হামিদা বেগম (৭০) কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হলেও এখন পর্যন্ত পুলিশ রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি। একজনকে আটক করা হলেও তার কাছ থেকে কোনো তথ্য পায়নি পুলিশ।
গত ২৩ এপ্রিল হাজীগঞ্জ পৌরসভার মাস্টারপাড়া নির্মাণাধীন ভবনের লিফটের ফাঁকাস্থান থেকে হাফেজ আব্দুল্লাহ আল কাউসারের (১৭) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় তার বাবা বাদী হয়ে হাজীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এতে ৩ জনকে আটক করে হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ।
চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় উপজেলার জনতা বাজারে ইমন হোসেন (৩০) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ইমন বাকিলা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের লোধপাড়া কবিরাজ বাড়ির হারুনুর রশিদের ছেলে। তিনি কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন এবং অটোরিকশা চালাতেন। নিহতের বাবা মো. হারুনুর রশিদ বাদী হয়ে হাজীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-১৪। মামলায় ১৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং ৯ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ১৩ জনকে আটক করে। তিনজন নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।
উক্ত ঘটনার ১০ দিন আগে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পরে চাঁদপুর লাকসাম রেলপথের হাজীগঞ্জ রেলস্টেশন সংলগ্ন বস্তির ঝুপড়ি ঘর থেকে মো. খলিল (১৭) নামে এক কিশোরের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। চাঁদপুর রেলওয়ে পুলিশ ও হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ যৌথভাবে গলায় গামছা মোড়ানো ঝুলন্ত মরদেহটি উদ্ধার করে। পরিবারের দাবি, তাকে কেউ হত্যা করে ঝুলিয়ে রেখেছে ঝুপড়ি এই ঘরটিতে।
গত বছরের ৬ নভেম্বর উপজেলার দোয়ালিয়া গ্রামে বালুর স্তুপের নিচ থেকে আরমান (১৫) নামে এক অটোরিকশা চালকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় হাজীগঞ্জ থানায় মামলা করে তার বাবা। খুনের সঙ্গে জড়িত তিনজনকে আটক করে পিবিআই।
গত বছরের ৮ অক্টোবর হাজীগঞ্জ বাজারস্থ ট্রাক রোড রেলি অফিস অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাজীগঞ্জ-ফরিদগঞ্জ সার্কেল অফিসের সামনে একটি বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় প্রবাসী ইমরান হোসেন (৪০) কে জবাই করে হত্যা করে তার স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিক আশিক এলাহী বাবু। এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত বাবুসহ সবাইকে আটক করে পুলিশ।
গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর রাতে উপজেলার বড়কূল গ্রামের কালা সীতা বাড়ি থেকে উত্তম (৬২) ও কাজলী (৫২) দুজনের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হাজীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের মেয়ে রিনা বর্মণ। এ মামলার অধিকাংশ আসামি আটক করেছে পুলিশ।গত বছরের ৭ মার্চ উপজেলার ১নং রাজারগাঁও ইউনিয়নের পিপিয়া গ্রামের বিল থেকে মো. আকতার হোসেন (৪৫) এর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আকতার মতলব দক্ষিণ উপজেলার ডিঙ্গাভাঙ্গা গ্রামের মিজি বাড়ির আবু তাহেরের ছেলে।
সবমিলিয়ে হাজীগঞ্জে গত ১৯ মাসে ঘটে যাওয়া ১৪টি খুনের ঘটনা পুরো উপজেলাবাসীর মধ্যে এক অভূতপূর্ব আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। অন্যথায়, হাজীগঞ্জ শহর সহ পুরো উপজেলায় অস্থিরতা আরও বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের জীবনে শান্তি ফেরানো কঠিন হয়ে পড়বে।
এই বিষয়ে হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, “আমি মাত্র দায়িত্ব নিয়েছি।
পর্যায়ক্রমে যেসব মামলায় এখনো রহস্য উদঘাটিত হয়নি কিংবা আসামি আটক হয়নি, সেসব বিষয়ে আমি কাজ করব।” এই ক্রমবর্ধমান হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কঠোর ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে, এমনটাই মনে করছেন উপজেলার বাসিন্দারা। পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া গেলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি ফিরে আসবে বলে মনে করেন তারা।