স্টাফ রিপোর্টারঃ শাহরাস্তিতে স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কোটি টাকার প্রকল্পের অর্থ আত্মসাত করায় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
শাহরাস্তি উপজেলার রায়শ্রী দক্ষিন ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে ১ নং ওয়ার্ড সদস্য (মেম্বার) মাহমুদ আলম ৫ টি, ৪ নং ওয়ার্ড সাবেক সদস্য (মেম্বার) মোঃ মোস্তফা কামাল ১ টি ও মোঃ শাহদাৎ হোসেন সাবেক সদস্য (মেম্বার) ১টি অভিযোগ উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা বরাবরে দায়ের করেন।
উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা অভিযোগগুলে তদন্ত করতে একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অভিযোগের সূত্র জানা যায়, শাহরাস্তি উপজেলার রায়শ্রী দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও তিন দশকের বেশি সময় ধরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বরত মোঃ আবদুর রাজ্জাক ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন প্রকল্প-খাত হতে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন।
লিখিত অভিযোগে প্রকাশ, একই ইউনিয়নের নাহারা মনু মিয়ার বাড়ি থেকে জলিল মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ (ইজিপিপি) প্রকল্পে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় ১৮ জন উপকারভোগীর বিপরীতে। সেখানে ১৯০ ফুট রাস্তায় মাত্র তিন দিন কাজ করেই প্রকল্পের ৭৫% টাকা উত্তোলন করেন। এছাড়াও ইউনিয়নের পরানপুর-রামপুর রাস্তায় ভূমি উন্নয়ন কর থেকে প্রাপ্ত অর্থ হতে ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে নাম মাত্র আরসিসি ঢালাই কাজ করে প্রায় ৩ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন।
ইউনিয়নের পরানপুর দক্ষিণ মাঠে ইমিগ্রেশন ড্রেইন নির্মাণ প্রকল্প দেখিয়ে কাজ না করে টিআর প্রকল্পের সাড়ে ৩ টন চাল উত্তোলন করেন। এছাড়াও নাহারা নোয়াবাড়ির পুকুর ঘাটলা ও মোল্লা বাড়িতে কালভার্ট নির্মাণ না করেই এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা আত্মসাত করেন। অপরদিকে পরানপুর- নাহারা মাজার রোডে দুই লাখ সাতাশি হাজার টাকার অপর একটি প্রকল্প দেয়া হয়। প্রকল্পে মাত্র ১৮০ ফুট আরসিসি ঢালাই কাজ করেই প্রকল্পের পুরো টাকা তুলে নেন চেয়ারম্যান নিজেই। এসব ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও রাজ্জাক বাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতো না।
চেয়ারম্যান বিগত সময়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন অতিদরিদ্রদের আত্মকর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) প্রকল্পে অনিয়ম করে অভিনব কৌশলে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাত করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রায়শ্রী দক্ষিণ ইউনিয়নে মোট ১১০ জন উপকারভোগীর বিপরীতে ইউনিয়নে ওয়ার্ড ভিত্তিক প্রকল্প ছিল পাঁচটি। এর মধ্যে ৪নং ওয়ার্ডের আহম্মদ নগর মনিরের দোকান থেকে চটকি বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ ও প্রসন্নপুর পশ্চিম পাল বাড়ির মন্দিরের ডোবা ভরাটের জন্য ২৩ উপকারভোগীর প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।
এ রাস্তার কাজ না করে নাম মাত্র প্রসন্নপুর পালবাড়ির ডোবা ভরাট করে সিংহ ভাগ টাকা আত্মসাত করে। নিয়মানুযায়ী এলাকায় প্রকল্পের সাইনবোর্ড সার্টানোর কথা থাকলেও তা তিনি লাগান নাই। ৬নং ওয়ার্ড ঘুঘুরচপ উত্তর পাটওয়ারী বাড়ি থেকে হাজীবাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নিমাণ প্রকল্পে উপকারভোগী ছিল ২০ জন। প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ রাস্তায় আগে থেকে ইটের সলিং থাকলেও প্রায় ১৫০ মিটার ইটের সলিংয়ের রাস্তার পাশে নামমাত্র মাটি দিয়ে প্রকল্পের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন চেয়ারম্যানসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
৭নং ওয়ার্ডের খিলা মনির উদ্দিন ভূঁইয়া বাড়ি থেকে খন্দকার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নিমাণ প্রকল্পে উপকারভোগী ছিল ২০ জন। প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ প্রকল্পেও নামমাত্র রাস্তার পাশে মাটি দিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়েছে।
৮নং ওয়ার্ড বেরনাইয়া নুর আলমের বাড়ি থেকে খিলা মোল্লা বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে উপকারভোগী ছিল ২৭ জন। ৪ লাখ ৩২ হাজার টাকার এ প্রকল্পে বেরনাইয়া নূর আলমের বাড়ি থেকে খিলা মোল্লা বাড়ি পর্যন্ত প্রকল্প দেয়া হলেও কাজ হয়েছে নূরুল ইসলাম তালুকদার বাড়ি থেকে ছফিউল্লাহ মার্কেট পর্যন্ত। এ প্রকল্পেও নিয়ম অনুযায়ী মাটির কাজ করা হয়নি। এমনকি প্রকল্পের সভাপতিও জানতেন না কত টাকার প্রকল্প এটি। প্রকল্পের চেয়ারম্যান মো. আবুল বাশার বলেন, প্রকল্প সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। এসব প্রকল্প সব চেয়ারম্যান নিয়ন্ত্রণ করেন। লেনদেনও চেয়ারম্যানের হাতেই হয়।
১ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য মাহমুদ আলম জানান, আমার ওয়ার্ডে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ হলেও আমি কখনো জানার সুযোগ হয়নি। চেয়ারম্যান নিজ দায়িত্বে সব কাজ করেন। কাজের ভালোমন্দ নিয়ে আমি স্থানীয়দের অনেক প্রশ্নের মুখে পড়লেও জবাব দেয়া সম্ভব হয় না। চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক ১২০টি মোবাইল সিম নিজ দায়িত্বে রেখে বিভিন্ন জনের ভাতা আত্মসাত করেন। এখানে চেয়ারম্যান-ই যেন শেষ কথা।
দলীয় প্রভাব ও চেয়ারম্যানের নিজস্ব বাহিনীর ভয়ে এতোদিন কেউ মুখ না খুললেও গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেরিয়ে আসছে বিভিন্ন তথ্য। স্থানীয় লোকজন জানান, চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক তার মেয়ের জামাই মোহাম্মদ উল্যা এই দুই জনই বিভিন্ন অনিয়মের হোতা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান মোঃ আঃ রাজ্জাক মুঠোফোনে জানান, তিনি কোনো অনিয়ম করেন নি। নিয়ম মেনেই এসব প্রকল্পের কাজ হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইয়াসির আরাফাত বলেন, অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি, তদন্তের জন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।