এস এম ইকবাল, ফরিদগঞ্জ: ফরিদগঞ্জে সিআইপি বাঁধের কারণে নাব্যতা হারিয়ে খরস্্েরাতা ডাকাতিয়া এখন মৃত প্রায়। তদুপরি চলছে মরার ওপর খাড়ার ঘা। বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য বাঁধ নির্মাণ করে সেচ পানির প্রবাহ আটকে দেয়া হয়েছে।
দীর্ঘদিন যাবত ফরিদগঞ্জ-কেরোয়া ব্রীজের নীচে ও দুই প্রান্তে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা বর্জ্য, ধুলা-মাটি ফেলছে। কসাইরা গবাদি পশু জবাই করে রক্ত, মলসহ নানা অংশ ফেলছে। এতে নদীর তলদেশ অনেকখানি ভরাট হয়ে গেছে। পরিবেশ ও প্রাণ প্রকৃতির ক্ষতি সাধনসহ সেচ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
ইতোমধ্যে ব্রীজের দুই তীর থেকে প্রায় অর্ধেক অংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে। নদী দখলে নেয়ার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কেউ এমন কাজ করতে পারে বলে এলাকাবাসী ধারণা করছেন। দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী করা হয়েছে। ইউএনও বলেছেন, বর্জ্য অপসারণের জন্য আমার হাতে এতো বড় অংকের প্রকল্প নেই।
এলাকাবাসী ও বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ফরিদগঞ্জ বাজারের দুইদিকে ডাকাতিয়া নদীর শাখা প্রবাহিত। যা উন্মুক্ত জলাশয়। ফরিদগঞ্জ বাজার সংলগ্ন ডাকাতিয়ার ওপর নির্মিত কেরোয়া সেতু। গভীর রাতে সেতুর নীচে দুই তীর থেকে সারিবদ্ধভাবে বর্জ্য, ধুলা-মাটি ও ভারি আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর তলদেশ থেকে ৭/৮ ফিট ভরাট হয়ে গেছে বলে এলাকাবাসীর ধারণা। সেতরু ওপর দাঁড়ালে নীচে শুধু আবর্জনা দেখা যায়। পানির দেখা মিলে না। অবৈধভাবে নদী ভরাটের এ কাজটি চলছে প্রায় দুই বছর যাবত। এ কাজ বন্ধ না হলে অচিরেই ব্রীজের নীচে সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে কৃত্রিমভাবে বাঁধ সৃষ্টি হবে।
নদী দখলে নেয়ার উদ্দেশ্যে এটি কারও কৌশল কি না- এলাকাবাসীর মধ্যে এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অপরদিকে কসাইরা গবাদি পশু জবাই করে রক্ত, মলসহ নানা অংশ সেখানে ফেলছে। পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।
সূত্রে জানা গেছে, সেতুর পশ্চিমদিকে ডাকবাংলোর নিকট ১৯৮৯ সালে তৎকালীন এমপির নির্দেশে মাছ চাষের উদ্দেশ্যে নদীতে মাটি ফেলে বাঁধ দেয়া হয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পর সে প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে ‘বদ্ধ জলাশয়’ উল্লেখ করে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন থেকে লীজ নিয়ে সেতুর নীচে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করা হয়। এতে, উপজেলার পূর্বাঞ্চলে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ জীব বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। মৎস্যজীবীদের জীবীকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে পড়ে। এর ফলে, কমরেড আলমগীর হোসেন দুলালের নেতৃত্বে ‘ফরিদগঞ্জ মৎস্যজীবী সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন আন্দোলনে নামে। তারা উপজেলা, জেলা প্রশাসন ও বিভাগীয় কমিশনার বরাবর স্মারকলীপি প্রদানসহ নানা কর্মসূচী পালন করেন। তৎকালীন নির্বাহী অফিসার আবদুন নূর এর নির্দেশে অভিযোগের তদন্ত করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুনির চৌধুরী। তদন্তে ও রেকর্ডপত্রে জলাশয় ‘উন্মুক্ত’ হিসেবে প্রমাণ মিলে। এতে, লীজ বাতিলের সুপারিশসহ রিপোর্ট পেশ করা হয়। রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার সরজমিন তদন্ত করেন। তিনি ওই জলাশয়ের লীজ বাতিলের সুপারিশ করলে, লীজ বাতিল করা হয়।
এলাকাবাসী বলেছেন, কেরোয়া ব্রীজের নীচে কৃত্রিম বাঁধের ফলে ইতোমধ্যে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে ফসল উৎপাদন, পরিবেশ ও প্রাণ প্রকৃতির ক্ষতিসাধন হচ্ছে। এর পূর্ব-দক্ষিণ দিকে রুমুর খাল হয়ে পানি প্রবাহ চলে গেছে উপজেলার পূর্ব-দক্ষিণ দিকে ৭-৮ নং পাইকপাড়া, ১৫ নং রূপসা, ৬ ও ৫ নং গুপ্টি ইউনিয়নে। ওইসব এলাকায় রুমুর খালের বুকের ওপর দিয়ে পানি বয়ে নিয়ে আরও কয়েকটি খাল-বিলে পানি পড়ে। সেচসহ জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করছে ওই পানি। সময় মতো পানি না পেয়ে জীব বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্তসহ প্রতি বছর ইরি-বোরো ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়।
গত প্রায় দেড় মাস পূর্বে চলতি ইরি বোরো মৌসুমে মাঠ চিরে চৌচির হয়ে গেছে। হাহাকার দেখা দেয় কৃষকের মাঝে।
গণমাধ্যমে ওই রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক, ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি)সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাগণ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। প্রশাসনের নির্দেশে বাগাদি সøুইচ গেইট দিয়ে পানি সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু, এমনটা জরুরী ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য হয়েছে। নদীতে তৈরি হওয়া নানাবাঁধ ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করা না হলে সেচ পানির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থাকবে না।
এছাড়া, ব্রীজের দুই প্রান্তে অন্তত ৪০ ফিট ভরাট করে ফেলা হয়েছে। প্রথমে বর্জ্য পরে মাটি ফেলে ওই ভরাট কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। সেখানে (উত্তর প্রান্তে) পাকা স্থাপনাও নির্মাণ হয়েছে। ব্রীজের দুই প্রান্তে নির্মিত স্থাপনা সরকারী ভূমিতে কি না- রেকর্ডপত্র খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন এলাকাবাসী। ব্রীজের কাছে ব্যবসা করেন এমন লোকজন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানিয়েছেন, গভীর রাতে বর্জ্য ফেলতে যায় কয়েকজন শ্রমিক। তাদের নিষেধ করলে উল্টো ধমক দেয়া হয়েছে। তারা আরও বলেছেন, এখানে নদীর ওপর পাকা ঘর নির্মাণ করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে গবাদি পশু জবাই করা হয়। পশু রক্ত, মল ও অন্যান অংশ নদীতে ফেলা হয়। এতে, পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। রোগ-বালাইয়ের কবলে পড়ছেন তারা। দুর্গন্ধে সয়লাব হচ্ছে চারিদিক। পাশ দিয়ে চলাচল করাও দুষ্কর। সেখানে গবাদি পশু জবাই করা বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন লোকজন।
ব্রীজের নীচে নদীতে বর্জ্য ফেলার বিষয়ে মুঠোফোনে কথা হয় ফরিদগঞ্জ পৌরসভার প্যানেল মেয়র আবদুল মান্নান পরান এর সঙ্গে। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, নদীতে ময়লা ফেলছে কে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নদী থেকে ময়লা অপসারণের কথা ইউএনও কবে বলেছেন আমি জানি না, বললে আমি জানতাম।
ইউএনও তাসলিমুন নেছা বলেছেন, ব্রীজের দুপাড়ের বর্জ্য আমার নজরে পড়েছে। তা ফেলতে নিষেধ করেছিলাম। শুনছে না। বাধ্য হয়ে মোবাইল কোর্টও করেছি। তাতেও কাজ হয়নি। আপনি যেভাবে দেখালেন, এমন করে নজরে পড়েনি। মেয়র, কাউন্সিলর ও বাজার ব্যবসায়ী কমিটির নেতৃবৃন্দকেও জানিয়েছি। সেখান থেকে কোনো সদুত্তর ও সাড়া পাইনি। বর্জ্য অপসারণের জন্য আমার হাতে এতো বড় অংকের প্রকল্প নেই। তবে আমি জেলা প্রশাসককে জানাবো। পরিকল্পিতভাবে কেউ ভরাট করছে কি না- ভাববার বিষয়।