চাঁদপুর বড়স্টেশনে আধুনিক ইলিশ অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য চিঠি

চাঁদপুর খবর রির্পোট: চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইলিশের বাড়ি” খ্যাত চাঁদপুর জেলার বড়স্টেশনে একটি আধুনিক ইলিশ অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

গত ৫ মে ২০২৫খ্রিস্টাব্দ মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দেন চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন।

এতে বলা হয়, দেশের অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক নদী বন্দর চাঁদপুর। নদী বন্দর হওয়ার কারণে ঐতিহাসিকভাবে চাঁদপুরকে ঘিরে ইলিশ মাছের সুবিস্তৃত বাণিজ্যিক কর্মকান্ড অব্যাহত রয়েছে। পার্শ্ববর্তী জেলা শরিয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, লক্ষীপুর, নোয়াখালী এবং ভোলা হতে প্রতিদিন আহরিত প্রচুর ইলিশ চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশনে অবস্থিত বিশাল মৎস্য আড়ৎ এ ক্রয়-বিক্রয় হয়।

পদ্মার রূপালী ইলিশ ক্রয়-বিক্রয় এবং রপ্তানীর সবচেয়ে বড় বাজার এই চাঁদপুরের বড়স্টেশন মৎস্য আড়ৎ।
ইলিশ মাছ একটি অতিমাত্রায় পঁচনশীল পণ্য। ইলিশ মাছের এই পঁচনশীল গুণাগুণের কারণে এটি আড়ৎ এ অবতরণের সময় বৈজ্ঞানিক উপায়ে অবতরণ, অতিদ্রুত গতিতে হিমায়িতকরণ এবং বাজারজাতকরণ প্রয়োজন। বর্তমানে বড়স্টেশনে অবস্থিত মৎস্য আড়তে আধুনিক উপায়ে ইলিশ মাছ অবতরণ, হিমায়িতকরণ এবং বাজারজাতকরণের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই।

সেকারণে উল্লেখ যোগ্য পরিমাণ ইলিশ মাছ চাঁদপুরে অবতরণ করলেও সমন্বিত মাছ আহরণ, হিমায়িতকরণ এবং বাজারজাতকরণের সুযোগ সুবিধা অপ্রতুল থাকায় প্রতিবছর চাঁদপুরের মৎস্যজীবীরা অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

তাই, চাঁদপুরের বড় স্টেশনে একটি আধুনিক ইলিশ মাছ অবতরণ কেন্দ্র স্থাপন করা স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের দীর্ঘদিনের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে চাঁদপুরসহ আশপাশের সকল জেলার মৎস্যজীবীদের জন্য মাছ সংরক্ষণ, বিপণন ও বিতরণ অভূতপূর্ব সুফল বয়ে আনবে। পাশাপাশি চাঁদপুর থেকেই ইলিশ মাছ রপ্তানীসহ মৎস্যভিত্তিক পর্যটনের অপার সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।

জেলা প্রশাসক সম্মেলন-২০২৫ এ নিম্নস্বাক্ষরকারী কর্তৃক চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশনে তিনতলা বিশিষ্ট একটি আধুনিক ইলিশ মাছ অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। যেখানে আধুনিক বরফকল, নিলামশেড, আড়ৎঘর, মিনি ডকইয়ার্ড, পানি বিশুদ্ধকরণ ফিল্টার, পল্টুনের পাশাপাশি মাছ হিমায়িতকরণ ও প্যাকেজিং এর আধুনিক সুযোগ সুবিধা, মৎস্য জাদুঘর, মৎস্য ভিত্তিক কর্পোরেট অফিস স্পেস, ব্যাংক এবং রেস্তোঁরার সুবিধা থাকবে। আধুনিক এই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রকে ঘিরে চাঁদপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৬ টি জেলার প্রায় ১কোটি মানুষ বিশেষ করে মৎস্যজীবীদের জীবন যাত্রার আমূল পরিবর্তন হবে। এছাড়া ‘ইলিশের বাড়ি’ চাঁদপুর এ ইলিশ প্রেমী পর্যটকদের জন্যও অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হবে।

উল্লেখ্য, এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চাঁদপুরের বড়স্টেশনে পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, জেলা প্রশাসক সম্মেলন-২০২৫ এ নিম্নস্বাক্ষরকারী কর্তৃক প্রস্তাবিত এই প্রকল্পটি বিবেচনার জন্য মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

চিঠির সাথে প্রস্তাবিত প্রকল্প হলো- চাঁদপুর জেলার বড় স্টেশনে তিনতলা বিশিষ্ট একটি আধুনিক ইলিশ মাছ অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণ।

প্রকল্পের যৌক্তিকতা: মাছ আমাদের জন্য উচ্চমানের প্রোটিন সরবরাহ করে। কিন্তু যেহেতু মাছে অতিদ্রুত ব্যাক্টেরিয়াল সংক্রমণ ঘটে তাই মাছ অতিদ্রুত মাত্রায় পচনশীল একটি পন্য। সঠিক সময়ে মাছ সংরক্ষন করতে না পারলে তা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে। অতিমাত্রায় পঁচনশীল হওয়ার কারণে মাছের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত হ্যান্ডলিং, বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ এবং দ্রুতগতির পরিবহন ব্যবস্থা।

নতুন নতুন ফিশিং গ্রাউন্ড সৃষ্টি করা, মাছ চাষের এলাকা বৃদ্ধি করা, মৎস্য অবতরণ ও সংরক্ষণ সুবিধাদিসহ বিপণন ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ এর আর্থ সামাজিক গুরুত্ব বৃদ্ধি করা যেতে পারে। মানসম্মত অবতরণ, সংরক্ষণ, বিপণন ও বিতরণ সুবিধাদির অভাবে মাছের গুণগতমান হ্রাস পায়। এমনকি মাঝেমধ্যে এর খাদ্যগুণও নষ্ট হয়ে যায়।

পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়ার মিলনস্থল চাঁদপুর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা শরিয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, লক্ষীপুর, নোয়াখালী, ভোলার জেলেদের জন্য ইলিশ মাছ ক্রয়-বিক্রয়ের সবচেয়ে বড় বাজার। নদ-নদী বেষ্টিত এসব জেলার মৎস্যজীবীরা তাদের আহরিত ইলিশ মাছের অধিকাংশই চাঁদপুরের বড় স্টেশন মৎস্য আড়ৎ এ বিক্রি করে থাকে। আলোচ্য প্রকল্পের মাধ্যমে স্থাপিত সুবিধাদী নদী বেষ্টিত চাঁদপুর এবং এর আশপাশের জেলায় উৎপাদিত ইলিশ মাছের স্বাস্থ্যসম্মত অবতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।

প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: উন্নতমানের অবতরণ ও বিপণন সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ক্ষতিকর ও রাসায়নিক পদার্থ মুক্ত ইলিশ মাছ সরবরাহ করা।

চাঁদপুরে আধুনিক ইলিশ মাছ অবতরণ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে ইলিশ মাছ অবতরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। ইলিশ আহরণ, প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং ও বিপণন এর কাজে জড়িতদের জন্য নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। বিশেষত ইলিশ বাছাই, প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেজিং এর কাজে জড়িত মহিলাদের জন্য বর্ধিত হারে কর্ম সুজন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করা। ইলিশ মাছের আহরনোত্তর অপচয় কমানো।

ইলিশ ব্যবসায়ীদের জন্য উন্নতমানের ইলিশ অবতরণ ও বিপণন সুবিধা নিশ্চিতকরণ। ইলিশ মাছের পোষ্ট হারভেষ্ট লস কমানো এবং বাজার নেটওয়ার্ক উন্নয়ন। আহরণকৃত ইলিশ মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহের সুবিধা প্রদান।

প্রকল্পের অবকাঠামো: প্রস্তাবিত প্রকল্পে একটি তিনতলা বিশিষ্ট আধুনিক ভবন নির্মান করা হবে। নদী তীরে নৌযান ভিড়ানোর জন্য আধুনিক মিনি ডকইয়ার্ড, পল্টুন এবং মাছ নৌযান থেকে তোলার জন্য কনভেয়ার বেল্ট স্থাপন করা হবে। কনভেয়ার বেল্টে করে ইলিশ মাছ সরাসরি প্রস্তাবিত চারতলা ভবনের নিচতলায় অবস্থিত আধুনিক মৎস্য আড়ৎ এ চলে যাবে। ভবনের বিভিন্ন তলায় যেসকল সুযোগ সুবিধা থাকবে তা নিম্নরূপঃ

নিচ তলা: ইলিশ বিপণনের জন্য আড়ৎ ঘর যেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা মাছ ক্রয় বিক্রয় ও নিলাম করতে পারবেন। এরই সাথে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বরফকল এবং মাছ হিমায়িতকরণের সুবিধা থাকবে এখানে। বিদেশে মাছ রপ্তানীর জন্য যথাযথ প্যাকেজিং ও লেবেলিং এর সুবিধা থাকবে। পানি বিশুদ্ধ করণের জন্য ফিপ্টারের সুবিধা থাকবে যেখান থেকে নিয়মিত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে।

দ্বিতীয় তলা: এখানে একটি ইলিশ জাদুঘর স্থাপন করা হবে। যেখানে চাঁদপুরের মৎস্য সম্পদের ইতিহাস তুলে ধরা হবে। এছাড়াও এখানে চাঁদপুরের রূপালি ইলিশ এর বিস্তারিত গবেষণার তথ্যাদি তুলে ধরা হবে। পর্যটক ও ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এই জাদুঘর হবে প্রাচীন নদীবন্দর চাঁদপুর সম্পর্কে জানার জন্য এক চমৎকার স্থান।
তৃতীয় তলা: প্রস্তাবিত এই ভবনের তৃতীয় তলায় থাকবে মৎস্যভিত্তিক কর্পোরেট কোম্পানীর জন্য অফিস স্পেস। এখানে অফিস স্থাপন করে তারা দেশে ও বিদেশে চাঁদপুরের মাছ সরবরাহ ও বিপণনের কাজ করতে পারবে।

এছাড়াও এখানে ব্যাংকিং সুবিধা রাখার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের ব্রাঞ্চ স্থাপন করা হবে, যাতে করে মাছ রপ্তানী করার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা হাতের কাছেই এলসি খোলা ও অন্যান্য ব্যাংকিং সুবিধা পেতে পারেন।
ছাদ রেস্তোরা: ইলিশ প্রেমী পর্যটকদের আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে এই ভবনের ছাদে একটি নান্দনিক রেস্তোঁরা স্থাপন করা হবে।

যেখানে পর্যটকরা তাদের পছন্দের তাজা ইলিশ মাছের স্বাদ নিতে পারবেন। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লঞ্চ যোগে চাঁদপুরে এসে অতি সহজেই এই রেস্তোঁরায় পর্যটকরা আহার করতে পারবেন। এরই সাথে চাঁদপুরের ইলিশ মাছ প্রসেসিং ব্যবস্থা স্বচক্ষে অবলোকন করতে পারবেন।

সম্পর্কিত খবর