
ফরিদগঞ্জ প্রতিনিধি: ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য পর্যাপ্ত ও সমতাভিত্তিক পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্য বিধিসম্মত জীবন রীতিতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং খোলা জায়গায় মলত্যাগের অবসান ঘটানোর লক্ষে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) অর্থায়নে ফরিদগঞ্জে টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণে অনিয়ম ও অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিটি ল্যাট্রিন নির্মাণে বরাদ্দ অর্থের এক তৃতীয়াংশ অর্থে এসব নির্মাণ কাজ চলছে। ফলে প্রশ্ন রয়েছে এসবের মান নিয়েও। অভিযোগ রয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভার্গে কর্মকর্তারও এর সাথে জড়িত।
জানা গেছে, ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ শীর্ষক এ প্রকল্পের আওতায় দেশের ৩০ জেলার ৯৮টি উপজেলায় দরিদ্র জনগণের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন কার্যক্রম চলছে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে ৯৭ শতাংশ ঋণ নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাকি ২ শতাংশ টাকা নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিচ্ছে সরকার। স্থানীয় সরকার বিভাগের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। কাজ শেষ হবে চলতি বছর ২০২৫ সালে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পের আওতায় নির্বাচিত এলাকায় অতিদরিদ্রদের জন্য সারা দেশে ৩ লাখ ৫১ হাজার ২৭০টি হতদরিদ্র পরিবারে বিনামূল্যে টুইন পিট ল্যাট্রিন কাজ চলছে। যার মধ্যে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে ইউপি চেয়ারম্যানদের সহায়তায় প্রতিটি ইউনিয়নে ২২৯টি পরিবারের তালিকা তৈরি করে প্রকল্পের সহযোগি এনজিও ঔঠ-৩ উঙজচ ্ ডধঃবৎঅরফ এর স্থানীয় প্রতিনিধিরা। সেই হিসেবে ফরিদগঞ্জ উপজেলার মোট ৩৪৩৫ টয়লেট নির্মিত হচ্ছে ।
সূত্র জানায়, প্রতিটি টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণে ৩৫ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সেই হিসেবে ফরিদগঞ্জ উপজেলাতেই ব্যয় হবে ১২ কোটি ২২লাখ ৫ হাজার টাকা।
কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। কাজ চলছে নামকাওয়াস্তে। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নের এত নিম্নমানের হওয়া বিস্ময় প্রকাশ করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। প্রতিটি ল্যাট্রিন নির্মাণে কিছু ইট, ১০টি রিং, দুইটি স্লাব এবং ৪ইঞ্চি ব্যাসার্ধের সিমেন্টের তৈরি পিলার এবং টিন প্রয়োজন। কিন্তু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই উপকরণ নির্মাণে দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন। কাজগুলো নিম্মমানের হচ্ছে। ইটের গুড়া ৮০% আর ১৮%কক্রিট বাকি ২%বালি সিমেন্ট। তারা ১০টি রিং তৈরি করছে দেড়/দুই বস্তা সিমেন্ট দিয়ে এমনটাই জানিয়েছেন কর্মরত লেবাররা।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি টয়লেট নির্মাণে প্রকল্প কর্তৃক ব্যয় ৩৫ হাজার টাকা ধরা হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ ২২/২৩ হাজার টাকা। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এগুলো নির্মাণে সর্বোচ্চ ১০/১২ হাজার টাকা ব্যয় করছেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নিম্নমানের ইটের সুড়কি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রিং ও স্ল্যাব। যার ফলে এগুলো মান নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
একটি টয়লেট পাওয়া রূপসা উত্তর ইউনিয়ন এর বাসিন্দা মেহেরাজ হোসেন বলেন,এই টয়লেট এক বছরও টিকবে না তবে এটা থেকে ভেঙ্গে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রূপসা বেপারী বাড়ির বোরহান উদ্দিন জানান, তার বাড়িতে তিনটি টয়লেট নির্মাণ হবে। কিছুদিন আগে এসে ঠিকাদারের লোকজন কিছু রিং তৈরি করে যায়। কিন্তু বৃষ্টিতে সেগুলো ভেঙ্গে নষ্ট হয়েছে।
ধানুয়া গ্রামের সিএনজি চালক হানিফ জানান, একমাস পূর্বে শুধু ফ্লোর পাকা করে চলে গেছে। আর খবর নেই। আমরা খুব কষ্টে আছি।
ফরিদগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়নের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানিয়েছেন তার কাছ থেকে এক জনপ্রতিনিধি তালিকা নাম উঠাতে ২ হাজার টাকা নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের এই কাজের পিছনে জেলা জনস্বাস্থ্য নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে শুরু করে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সকলেই জড়িত। তথ্য জানতে চাইলে তারা লুকোচুরি করছে। অন্যদিকে নাম তালিকাভুক্ত করতে জনপ্রতিনিধিরাও নিয়েছেন অর্থ।
প্রকল্পের সহযোগি এনজিওর ফরিদগঞ্জ উপজেলার একজন ফ্যাসিলেটর জানিয়েছেন, গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে তারা টয়লেট নির্মাণ কাজ তদারকি করতে গিয়ে দেখেছেন নিম্নমানের ইট বালু দিয়ে রিং স্লাব তৈরি হচ্ছে। এই বিষয়ে তারা তাৎক্ষনিক প্রকল্প অফিসকে অবহিত করেছেন। নির্বাহী প্রকৌশলী এসব দেখেও না দেখার অবস্থায় রয়েছেন।
উপজেলার রূপসা উত্তর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম বলেন, নিম্নমানের কাজ হচ্ছে। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে রিংগুলো গাড়ীতে উঠানোর সময়ে ভেঙ্গে যায়। এতবড় প্রকল্প, অথচ কাজ নিম্নমানের। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের লোকজনের যোগসাজসে এসব কাজ হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ আলম শেখ বলেন, কাজের গুণগতমান ঠিক হচ্ছে না। ধানুয়া স্কুলের পাশের একটি বাড়িতে টয়লেট নির্মানের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই হতদরিদ্রকে কিছু ইট, বালি এবং নগদ অর্থ রাখতে বলেছেন। এগুলো দেখার কেই নেই।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে এক জনপ্রতিনিধি জানান, বিশ্বব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১২কোটি টাকার কাজ হচ্ছে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে এগুলো কিছুই জানিনা আমরা। তবে কাজের গুণগতমান দেখে বুঝা যাচ্ছে বড় অংকের টাকা লুটের আয়োজন চলছে।
এনজিও ঔঠ-৩ উঙজচ স্থানীয় প্রতিনিধি নুরুন্নাহার চৌধুরী বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে যে পরিবারের স্যানিটেশন সমস্যা তা নিশ্চিত করে তালিকা করা। নির্মাণ বিষয় তদারকি করছেন জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
স্থানীয় ঠিকাদার জানান, প্রতিটি টয়লেট নির্মাণে তারা সর্বোচ্চ ২৩হাজার ৫শ টাকা পাচ্ছেন তারা।
এর ভ্যাট. ট্যাক্স এবং অফিস খরচ এর মধ্যে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপসহকারি প্রকৌশলী ফরিদ হোসেন বলেন, কাজের গুণগতমান স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কথা এড়িয়ে যান।
বিশ্ব ব্যাংকের চাঁদপুর জেলা কো-অর্ডিনেটর আবু হুয়ারা প্রথমে এই প্রকল্প বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়র চেষ্টা করেন। পরে তিনি মুঠো ফোনে বলেন, এরকম একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে ওই প্রকল্প সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী।