চাঁদপুর সদরে সরকারি চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ

আহম্মদ উল্যাহ : পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দরিদ্রদের মাঝে ভিজিএফের ১০ কেজি করে চাল বিতরণের জন্য দেয় সরকার। আর এই চাল বিতরণে চাঁদপুর সদরে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে স্ব স্ব ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের (সচিব) বিরুদ্ধে। অধিকাংশ ইউনিয়নে গরিব ও হতদরিদ্র পরিবারগুলেঅ জন্য বরাদ্দৃকত চাল থেকে বঞ্চিত। সরজমিনে তদন্তকালে এমনই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে ।

জানা গেছে, চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দরিদ্রদের মাঝে ভিজিএফের ১০ কেজি করে চাল বিতরণে কোন নিয়ম না মেনেই এই চাল বিতরণ করা হয়। যার কারণে অনেক ইউনিয়নগুলোতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সেই সাথে ইউনিয়নে প্রাপ্ত ও প্রকৃত নাগরিকগন বঞ্চিত হয়েছে ।

অভিযোগ উঠেছে যে, গরিব ও হতদরিদ্রদের জন্য চাল বরাদ্দ আসলেও স্থানীয় কতিপয় নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ (সচিব) মিলে নিজেদের ইচ্ছামত এই চাল বিতরণ করেন। তদারকি বলতেই নেই কিছুই । চাল বিতরণ কালে সরকারি টেক অফিসারদের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা উপস্থিত থাকেন না । তাই এমন অনিয়ম হরহামেশাই হচ্ছে । যেন দেখার কেউ নেই ।

এ ব্যাপারে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক ও চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সুদৃষ্টি কামনা করেন বঞ্চিত গরিব ও হতদরিদ্র পরিবার।

গতকাল সদরের ইউনিয়ন পরিষদ গুলোতে গেলে স্থানীয় গরিব ও অসহায় দরিদ্র মানুষ অভিযোগ করে বলেন, সরকার আমাদের জন্য চাল দিলেও বর্তমান কতিপয় নেতা-কর্মীরা ভাগ করে নিয়ে যায়। নির্ধারিত ১০ কেজির পরিবর্তে নিজের অনুগত কয়েকজনকে আস্তা বস্তা তুলে দিতে দেখা গেছে। আবার ১০ কেজির স্থলে অনেককেই ৮ কেজি চাল দিতে দেখা যায় ।

স্থানীয় মেম্বার ও সাধারণ মানুষের সাথে আলাপকালে তারা অনেকেই জানান, এবার চাল বিতরণকালে ট্যাগ অফিসারগণ উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি। যার কারণে চাল কম দেওয়ার অভিযোগ করেছে অনেকেই।
জানা যায়, প্রতিটি ইউনিয়নে একটি বিজিএফ চাল বিতরণ কমিটি ছিলো, তার মধ্য জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, সমাজসেবী, ও সমাজসেবকসহ অনেকেই এ কমিটির অন্তর্ভূক্ত। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে এই কমিটি কার্যকারিতা ও উপস্থিতি পাওয়া যায় না। তবে রমজান ও ঈদ উপলক্ষে যে চাল বিতরণ করার কথা তা বর্তমান সমাজসেবক, শিক্ষক ও এলাকার ব্যাক্তিবর্গদের নিয়ে বিতরণের কথা থাকলেও ইউনিয়ন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা (সচিব) নিজেদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক কতিপয় স্থানীয় পছন্দমত বিএনপি নেতাকর্মীদের দিয়েই এই চাল বিতরণ কার্যক্রম শেষ করেন।

যার ফলে কয়েকটি ইউনিয়নে মারামারি হয়ে কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদিকে সোমবার (১৭ মার্চ) দুপুরে চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের জাটকা ধরা থেকে বিরত থাকা জেলেদের (বিজিএফ) চাল বিতরণকে কেন্দ্র করে বিএনপির দু’গ্রুপের সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০জন আহত হয়েছে। বহরিয়া বাজার ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স এলাকায় ৩ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড জেলেদের চাল বিতরণকালে এই ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন-ইউনিয়নের বহরিয়া এলাকার আক্কাস খাঁন, সুফিয়ান, আফজাল খান, বোরহান, রাব্বি গাজী, মুকসুদ মিজি, মহসীন মিজি, জায়েদ মিজি, মমিন হাওলাদার ও মন্টু মিজি।

আহতরা চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। এদের মধ্যে গুরুতর আহত রাব্বীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে কর্তব্যরত চিকিৎসক। ওই ইউনিয়নের ৭নম্বর ওয়ার্ড যুবদল সভাপতি মুকসুদ মিজি বলেন, গতকাল (রোবার) থেকেই জেলেদের চাল বিতরণ শুরু হয়েছে। ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নুরু ভুঁইয়া আজ (সোমবার) ৭নম্বর ওয়ার্ড লোকদের আসতে নিষেধ করে। যার কারণে কেউ আসেনি। কিন্তু দুরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখাগেছে নুরু ভুঁইয়ার লোকজন যাদের কোন জেলে কার্ড নেই তারা চালের বস্তা নিয়ে যাচ্ছে। তখন এই কাজে বাঁধা দিলে মারামারি সৃষ্টি হয়। এদিকে স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে এবং লোকজনের সাথে কথা বলে জানাগেছে, ইউনিয়নের ৩ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড জেলেদের মাঝে সরকারি চাল বিতরণকে কেন্দ্র করে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নুরু ভূঁইয়া অনুসারী আক্কাস খাঁন, সুফিয়ান, আফজাল খাঁন, বোরহান, রাব্বি এবং অপর পক্ষে ইউনিয়ন বিএনপি’র সহ-সভাপতি সুমন আহমেদ ভূঁইয়া,

তার অনুসারী আলমগীর মিজি, মুকছুদ মিজি, শাকিল, কাউসারসহ ১০ থেকে ১৫জন জেলেদের মাঝে সরকারি চাল বিতরণের সময় কিছু জেলে কার্ড ব্যতিত চাল নিতে চাইলে উভয়-পক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক ও হাতাহাতি হয়। হাতাহাতির একপর্যায়ে কার্ডধারী ও কার্ড ব্যতিত জেলেরা লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র এবং টেঁটা নিয়ে সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ে।ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি নুরু ভুঁইয়া বলেন, আমরা গতকালও (রোববার) উপস্থিত থেকে চাল বিতরণ করেছি। তখন ৭নম্বর ওয়ার্ড এর কয়েকজন চাল বিতরণের সময় সমস্যা তৈরী করেছে। তাদেরকে আজকে আসতে নিষেধ করেছি। কিন্তু তারাই আজকে এখানে হামলা ও মারামারির সৃষ্টি করেছে। জেলে কার্ডছাড়া চাল নিয়ে যাওয়াসহ আমার বিরুদ্ধে যেসব কথা বলা হচ্ছে এগুলো সঠিক না।

এই ঘটনায় চাঁদপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বাহার মিয়া বলেন, ঘটনার পর পুলিশ পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনার সময় বহরিয়া এলাকায় লক্ষীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সামনের রাস্তায় দু’পক্ষের লোকজন কাঁচের বোতল ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এসময় পুলিশ কয়েকটি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে।

ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে জাটকা রক্ষায় মার্চ-এপ্রিল দুই মাস অভয়াশ্রমে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এসময়ে কর্মহীন হয়ে পড়া জেলেদের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৪০ কেজি করে মোট ১৬০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এসব চাল ইউনিয়ন পরিষদ -ইউপি- থেকে নিবন্ধিত জেলেদের কার্ড যাচাই বাছাই করে বিতরণ করেন জনপ্রতিনিধিরা। চলতি জাটকা মৌসুমে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের ৮০ কেজি চালের মধ্যে ৩ থেকে ৪ কেজি করে চাল কম দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন জেলেরা।

অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের (সচিব) বিরুদ্ধেও তারা এই অনিয়মের সাথে জড়িত রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে জেলেদের চাল বিতরণ অনিয়ম এর আগেও অভিযোগ উঠলেও উপজেলা প্রশাসন তার বিরুদ্ধে অবস্থা না নেওয়ায় প্রতিবারই তারা অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। এতে স্থানীয় জেলেরা মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে গত (১২ নভেম্বর ২০২৪ খ্রি.) চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪ ইউনিয়নে গত ৫ আগস্টের পর চেয়ারম্যান ও প্যানেল চেয়ারম্যানগণ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় প্রশাসক নিয়োগের আদেশ দিয়েছে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। তবে চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষর করা এই আদেশ (১৩ নভেম্বর ২০২৪ খ্রি.) প্রকাশ্যে আসে।

নিয়োগ প্রাপ্ত প্রশাসকরা হলেন : বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে সদর উপজেলা প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব), আশিকাটি ইউনিয়নে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, কল্যাণপুর ইউনিয়নে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী, শাহমাহমুদপুর ইউনিয়নে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, রামপুর ইউনিয়নে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, মৈশাদী ইউনিয়নে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, তরপুরচন্ডী ইউনিয়নে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা,

বাগাদি ইউনিয়নে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, বালিয়া ইউনিয়নে সদর উপজেলা প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব), লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, ইব্রাহীমপুর ইউনিয়নে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, চান্দ্রা ইউনিয়নে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, হানারচর ইউনিয়নে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী ও রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।

তবে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে এবং সরকারী বরাদ্দ অর্থ যথাযথ গরিব ও অসহায়দের মাঝে পৌছে দিতে স্ব স্ব ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তগণ (সচিব) আরো দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করলে জনগণের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসবে।

এ ক্ষেত্রে সেনাবাহীর কর্মকর্তাগণ সহযোগিতা করলে যথার্থ সেবা নিশ্চিত হবে বলে আসা করা যায়। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক, এডিসি (ডিডিএলজি), এবং সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপ কামনা করেন স্থানীয়রা।

সম্পর্কিত খবর